দুর্নীতির বিরুদ্ধে বেনজীরের সেই সব বক্তব্য এবং তারপর...

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ

ডিজিটাল যুগের একটি সুবিধা হলো, কোনো কিছুই হারিয়ে যায় না। সহজেই হাতের কাছে, চোখের সামনে পাওয়া যায়। এ সুবিধা নিয়ে ইউটিউবে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের কিছু উদ্দীপনামূলক বক্তব্য শুনছিলাম। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর র‌্যাবের মহাপরিচালক থাকাকালে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, জঙ্গি, মাদক ও দুর্নীতির সঙ্গে কোনো আপস নেই।

অবসরে গেলে কেমন পুলিশ দেখতে চাই, গত ৩২ বছর নিজে সেই পুলিশ হওয়ার চেষ্টা করেছি। আবার আমার সহকর্মীদের সেই পথে মোটিভেট (উৎসাহিত) করেছি।
দৈনিক সমকালে বেনজীর আহমেদের সাক্ষাৎকার

বছর দু-এক পর দেওয়া বেনজীরের আরেকটি বক্তব্য আরও অনুপ্রেরণাদায়ী। সেখানে তিনি পুলিশের নবীন সদস্যদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে (১৪ জুন, ২০২১) দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ ঘোষণার ডাক দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি চাই, তোমরা পুলিশের এই ১ হাজার ৩০০ নবীন সদস্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করবে।’

আরও পড়ুন

বেনজীর আহমেদ এসব অনুপ্রেরণা যখন জোগাচ্ছিলেন, তখন নিজেই জানতেন যে তিনি সরকারের অনুমতি না নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় জমি কিনছেন, রিসোর্ট করছেন, সেই রিসোর্টে পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। নিজের পাসপোর্টটিও তিনি করিয়েছেন মিথ্যা তথ্য দিয়ে। তিনি পুলিশ বাহিনীর বড় পদে থেকেও পাসপোর্ট নিয়েছেন বেসরকারি চাকরিজীবী হিসেবে, যেটা সরকারি চাকরিবিধি ও পাসপোর্ট আইনে অপরাধ।

র‌্যাবের মহাপরিচালক থাকার সময় ২০১৬ সালে বেনজীর আবার বেসরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে পাসপোর্ট নবায়ন করান। তখন অবশ্য বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল পাসপোর্ট অধিদপ্তর। র‌্যাব সদর দপ্তরে চিঠিও দেওয়া হয়েছিল। জবাবে র‌্যাব সদর দপ্তরের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) আবদুল জলিল মণ্ডল অবিলম্বে বেনজীরের পাসপোর্ট প্রতিস্থাপনের অনুরোধ করে চিঠি দেন। এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বেনজীরকে পাসপোর্ট দেওয়া হয়। ছবি তোলা ও আঙুলের ছাপ নেওয়া হয় তাঁর বাসায় গিয়ে।
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের মালিকানাধীন সাভানা ইকোরিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্ক
ছবি: সাভানা রিসোর্টের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

বেনজীর আহমেদ ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান ২০১০ সালের ১৪ অক্টোবর। দৈনিক যুগান্তর–এ ৩ জুন প্রকাশিত ‘মিথ্যা পরিচয়ে বিশ্বভ্রমণ’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন বলছে, ওই দিনই বেসরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে বেনজীরের করা পাসপোর্ট (নবায়নকৃত এমআরপি বা মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট) তাঁকে দেয় ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর। উল্লেখ্য, এর মাত্র তিন দিন আগে পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন করেছিলেন বেনজীর।

যুগান্তরের প্রতিবেদন বলছে, ওই দফায় নবায়ন করা বেনজীরের পাসপোর্টের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ছিল ২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর। মেয়াদপূর্তির আগে তিনি ২০১৪ সালে বেসরকারি চাকরিজীবী পরিচয়েই পাসপোর্ট নবায়ন করেন।

বেনজীর আহমেদের ‘মোটিভেশনে’ পুলিশের কারা কারা উৎসাহিত হয়েছেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কি সেই খোঁজ নেবে?

র‌্যাবের মহাপরিচালক থাকার সময় ২০১৬ সালে বেনজীর আবার বেসরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে পাসপোর্ট নবায়ন করান। তখন অবশ্য বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল পাসপোর্ট অধিদপ্তর। র‌্যাব সদর দপ্তরে চিঠিও দেওয়া হয়েছিল। জবাবে র‌্যাব সদর দপ্তরের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) আবদুল জলিল মণ্ডল অবিলম্বে বেনজীরের পাসপোর্ট প্রতিস্থাপনের অনুরোধ করে চিঠি দেন। এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বেনজীরকে পাসপোর্ট দেওয়া হয়। ছবি তোলা ও আঙুলের ছাপ নেওয়া হয় তাঁর বাসায় গিয়ে।

আরও পড়ুন

সরকারি চাকরি আইনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়ার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বেসরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে বেনজীর আহমেদের পাসপোর্ট নেওয়া কি নিয়মের ব্যত্যয়? তিনি বলেন, এটা তথ্য গোপন, যা সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অসদাচরণ ও ফৌজদারি অপরাধ। এ ক্ষেত্রে যিনি পাসপোর্ট নিয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে এবং যাঁরা পাসপোর্ট দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। আর যাঁরা চাকরিতে আছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে।

আরও পড়ুন

যুগান্তরের প্রতিবেদনে উপস্থাপিত তথ্য নিয়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তর কোনো প্রতিবাদ পাঠায়নি বলে প্রতিবেদক বুধবার জানিয়েছেন। ফলে ধরে নেওয়া যায়, প্রতিবেদনটিতে তথ্যগত অসংগতি নেই।

২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর বেনজীর আহমেদ র‌্যাবের মহাপরিচালক থাকার সময় বলেছিলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আপস নেই। ওরা (দুর্নীতিবাজ ও জঙ্গি) বিদায় হবে। আমরা থাকব।’ বেনজীর আহমেদ সপরিবার বিদেশে চলে গেছেন।

পাসপোর্ট অধ্যাদেশের ১১ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বা সঠিক তথ্য লুকিয়ে অন্য নামে পাসপোর্ট নিলে, তা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ছয় মাসের কারাদণ্ড বা দুই হাজার টাকা জরিমানা।

আরও পড়ুন

আইন থাকবে, তা প্রয়োগ হবে না; কিন্তু সরকারি সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিসভা এবং বিচার বিভাগকে বেতন, ভাতা ও পরিচালন খরচ দিতে জনগণ কর দিয়েই যাবে, এটা যেন নিয়তি না হয়। সরকারের বাজেটের প্রতি ১০০ টাকার এখন ২৫ টাকার কাছাকাছি ব্যয় হয় জনপ্রশাসনে। বিপরীতে এক কেজি চিনি কিনতে আমরা ৪২ টাকার বেশি শুল্ক–কর দিই। উন্নয়ন যা হচ্ছে, তা কিন্তু বেশির ভাগ ঋণ নিয়ে।

২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর বেনজীর আহমেদ র‌্যাবের মহাপরিচালক থাকার সময় বলেছিলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আপস নেই। ওরা (দুর্নীতিবাজ ও জঙ্গি) বিদায় হবে। আমরা থাকব।’ বেনজীর আহমেদ সপরিবার বিদেশে চলে গেছেন।

বেনজীর আহমেদের বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তখনকার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেছিলেন, তুলনা করা ঠিক নয়, তবুও তিনি বলছেন জাতি যেমন জাতির জনকের অভাব অনুভব করে, তেমনি পুলিশ বাহিনী বেনজীর আহমেদের অভাব অনুভব করবে।

২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর বেনজীর আহমেদ র‌্যাবের মহাপরিচালক থাকার সময় বলেছিলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আপস নেই। ওরা (দুর্নীতিবাজ ও জঙ্গি) বিদায় হবে। আমরা থাকব।’ বেনজীর আহমেদ সপরিবার বিদেশে চলে গেছেন।

২০২০ সালের ২৪ জুলাই দৈনিক সমকালে বেনজীর আহমেদের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সেই সাক্ষাৎকারে শেষ প্রশ্ন ছিল, যখন অবসরে যাবেন, পুলিশকে কোন জায়গায় দেখতে চান? জবাবে বেনজীর বলেন, ‘অবসরে গেলে কেমন পুলিশ দেখতে চাই, গত ৩২ বছর নিজে সেই পুলিশ হওয়ার চেষ্টা করেছি। আবার আমার সহকর্মীদের সেই পথে মোটিভেট (উৎসাহিত) করেছি।’

বেনজীর আহমেদের ‘মোটিভেশনে’ পুলিশের কারা কারা উৎসাহিত হয়েছেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কি সেই খোঁজ নেবে?