কৃত্রিম হাত পেলেন, ভবিষ্যৎ নিয়ে তবু অন্ধকার দেখেন

মামুন মিয়ার কৃত্রিম হাত লাগিয়ে দেওয়া হলো। ২১ নভেম্বর, আগারগাঁওয়ে আইসিটি টাওয়ারেছবি: তানভীর আহাম্মেদ

কোরআনে হাফেজ মো. হোসাইন আহমেদ (২০) আরবি ও বাংলা লেখার জন্য বেশ প্রশংসা পেতেন। গত ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে পুলিশ একদম কাছ থেকে তাঁর ডান হাতে গুলি করে। পরদিন গুলি লাগা হাতটি কেটে ফেলতে হয়। বাবা নেই। পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরি করতেন। সেই চাকরি চলে গেছে।

২৫ বছর বয়সী যশোরের নাঈম হাসান। ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রলীগের কর্মীদের ধারালো অস্ত্রের কোপে ডান হাতটি ঝুলে যায়। ১৭ আগস্ট পর্যন্ত এভাবেই ঝুলে ছিল হাতটি। চিকিৎসায় চার লাখ টাকা খরচের পর হাতটি কেটে ফেলতে হয়েছে। এক বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে নাজিফা জান্নাতকে কোলে নিতে পারেন না নাঈম।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের আইসিটি টাওয়ারে হোসাইন আহমেদ, নাঈমসহ পাঁচ তরুণ হাজির হয়েছিলেন। রোবোলাইফ টেকনোলজিস নামে একটি প্রতিষ্ঠান এই তরুণদের কৃত্রিম রোবোটিক হাত লাগিয়ে দিয়েছে। এতে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে ব্যাবিলন গ্রুপ।

আজই এই তরুণেরা হাত পেয়েছেন। এখনো সুইচ টিপে কীভাবে হাতটি ব্যবহার করতে হবে, সেটার প্রশিক্ষণ পাননি তাঁরা। তবে সবার মুখেই হাসি। বিকল্প হাত দিয়ে হয়তো খুব বেশি কিছু করতে পারবেন না। তবে হাত নেই, এই অনুভূতি থেকে খানিকটা মুক্তি মিলবে। খাওয়াসহ দৈনন্দিন কিছু কাজ করতে পারবেন। এই হাত দিয়ে এক কেজি ওজনের যেকোনো কিছু তুলতে পারবেন।

দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি রোবোটিক হাত সংযোজনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, এই তরুণদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে দেশ মুক্তি পেয়েছে। তরুণদের এই যে কৃত্রিম হাত সংযোজন করে দেওয়া হলো, এটি দায়িত্বের জায়গা থেকে করা হয়েছে। তবে হিরো বা সন্তানদের জন্য যা করা হলো, তা আসলে তাঁদের অবদানের তুলনায় কিছুই নয়।

মো. হোসাইন আহমেদের কৃত্রিম হাত লাগিয়ে দেওয়া হলো। ২১ নভেম্বর, আগারগাঁওয়ে আইসিটি টাওয়ারে
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্ভাবনী অনুদানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের একমাত্র রোবোটিক হাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রোবোলাইফ টেকনোলজিস। ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ জনের বেশি মানুষের রোবটিক হাত সংযোজন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, তুরস্ক ও ভারতে এই রোবোটিক হাত ডেমো প্রোডাক্ট হিসেবে রপ্তানি করেছে তারা।

রোবোলাইফ টেকনোলজিসের প্রতিষ্ঠাতা জয় বড়ুয়া লাভলু রোবোটিক হাত সংযোজন কার্যক্রমের জন্য বিশ্বের শীর্ষ ১০ তরুণ রোবট গবেষকের তালিকায় স্থান পেয়েছেন।

অনুষ্ঠানে জয় বড়ুয়া পাঁচ তরুণের কৃত্রিম হাত লাগিয়ে দেন। জানালেন, কনুইয়ের নিচ থেকে হাত কাটা গেলে ব্রেন কন্ট্রোল আর কনুইয়ের ওপর থেকে কাটা গেলে অটো কন্ট্রোলের কৃত্রিম হাত লাগানো হয়। প্রত্যেকের জন্য আলাদা মাপের হাত বানাতে হয়। হাতটি খুব ভারী নয়। ফলে ব্যবহারকারী দীর্ঘ সময় এটি ব্যবহার করতে পারেন।

রোবোলাইফ টেকনোলজিসের উপদেষ্টা অন্তু করিম বলেন, বিদেশ থেকে এনে এ ধরনের একটি হাত প্রতিস্থাপনে কমপক্ষে ২০ লাখ টাকা খরচ হবে। অথচ দেশে তৈরি এ হাত লাগাতে অনেকের ক্ষেত্রে মাত্র ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। ক্ষেত্রবিশেষে খরচ আরেকটু বাড়তে পারে। দেশে কৃত্রিম হাতের চাহিদা অনেক। প্রযুক্তি, কাঁচামালসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা পাওয়া গেলে এ কার্যক্রম আরও সম্প্রসারণ করা সম্ভব।

কৃত্রিম হাত লাগানোর পর একসঙ্গে চারজন। ২১ নভেম্বর, আগারগাঁওয়ে আইসিটি টাওয়ারে
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

রোবোলাইফ টেকনোলজিস আয়োজিত অনুষ্ঠানে ব্যাবিলন গ্রুপের সিইও আরিফ ভূইয়া দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা এই তরুণদের জন্য যে কিছু একটা করতে পেরেছেন, সে জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

অনুষ্ঠানে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার সময় যশোরের নাঈম হাসান তাঁর কৃত্রিম হাতটি বাঁ হাতে ধরে রেখেছিলেন। জানালেন, তাঁর দুই বোনের মধ্যে এক বোনের বিয়ে হয়েছে। আরেক বোন কলেজে পড়ছেন। বাবা আধা সরকারি একটি সংস্থায় চাকরি করতেন। ডিপ্লোমা করার পর নাঈম একটি চাকরি করতেন। এখন ভবিষ্যৎ প্রায় অন্ধকার।

তবে দৃঢ়ভাবেই নাঈম বললেন, দেশের জন্য তাঁর একটি হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। তাঁর হাতের বিনিময়ে সুন্দর একটি দেশ চান তিনি।

কৃত্রিম হাত দিয়ে পানি পান করছেন আরিফ হোসেন। ২১ নভেম্বর, আগারগাঁওয়ে আইসিটি টাওয়ারে
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের মোড়ে ৪ আগস্ট আন্দোলনে অংশ নেওয়া আরিফ হোসেনের (সাগর) হাতে যুবলীগের কর্মীরা কোপ দিয়েছিলেন। এক মাস পর বাঁ হাতটি কেটে ফেলতে হয়েছে। একটি বায়িং হাউসে চাকরি করতেন আরিফ। চাকরিটা এখন আর নেই। এক বোন আর মা–বাবা আছেন।

আরিফ হোসেন বললেন, ‘আগের মতো জীবন তো আর হবে না। জীবনকে মানিয়ে নিতে হবে। তবে দেশের প্রয়োজনে হাত কাটা গেছে, এটা ভেবে শান্তি পাই।’

ভৈরবের মামুন মিয়া ট্রাক্টর চালাতেন। ১৯ জুলাই আন্দোলনে গেলে অস্ত্রধারীরা তাঁর হাতে কোপ দেয়। ২৫ জুলাই হাত কেটে ফেলতে হয়। আট বছর বয়সী ছেলে এবং পাঁচ বছর বয়সী এক মেয়ের বাবা মামুন মিয়া আর ট্রাক্টর চালাতে পারবেন না। কাজ করতে না পারলে সংসার চলবে কীভাবে, তা তিনি জানেন না।

১৯ বছর বয়সী আতিকুল ইসলামের ডান হাত কনুইয়ের ওপর থেকে কাটা। তবে তাঁর মুখের হাসি ম্লান হয়নি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর ওই দিন বিকেল চারটার দিকে রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানার কাছে আতিকুলের হাতে গুলি লাগে।

অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরে আসেন আতিকুল। কৃত্রিম হাত লাগানোর আগে সেদিনের ঘটনা সাংবাদিকদের কাছে বর্ণনা করেন তিনি। ২১ নভেম্বর, আগারগাঁওয়ে আইসিটি টাওয়ারে
ছবি: মানসুরা হোসাইন

আজ বৃহস্পতিবার আইসিটি টাওয়ারে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পর আতিকুল উপস্থিত হন। তারপর সেদিন ঘটে যাওয়া ঘটনা গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে বর্ণনা করেন তিনি।

কৃত্রিম হাত লাগানো পাঁচ তরুণ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে ভয় পাচ্ছেন। তাঁরা সরকারি সহায়তা চান, যাতে খেয়ে–পরে বাঁচতে পারেন। কৃত্রিম হাত লাগিয়ে দেওয়ায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তাঁরা।