ফরিদপুরে দুর্ঘটনা
বাস সনদহীন, ট্রাকে যাত্রী, সড়কে গর্ত, নিহত ১৪
মানুষের মৃত্যুর পর আবার বেরিয়ে এল অনিয়মের চিত্র। গতকাল বিভিন্ন জেলায় মৃত্যু আরও ১০ জনের।
ফরিদপুরে বাস ও ছোট ট্রাকের সংঘর্ষে সড়কে মৃত্যু হলো ১৪ জনের। তাঁদের মৃত্যুর পর জানা গেল, যে বাসটি দুর্ঘটনায় পড়েছে, সেটির ফিটনেস সনদ ও রুট পারমিট নেই। মারা যাওয়া যাত্রীরা ছিলেন একটি ছোট ট্রাকে, যাতে যাত্রী পরিবহন আইনে একেবারেই নিষিদ্ধ।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও হাইওয়ে পুলিশের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, দুর্ঘটনার স্থানে মহাসড়কে কিছু খানাখন্দ ছিল। বাসের চাকা গর্তে পড়ে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন। অবশ্য বিআরটিএর কোনো কোনো কর্মকর্তা বলছেন, বাসটির চালক দীর্ঘ যাত্রায় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তেও পারেন।
ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ফরিদপুর সদরের দিগনগর তেঁতুলতলায় গতকাল মঙ্গলবার সকালে এ দুর্ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, দুর্ঘটনায় পড়া বাসটি ইউনিক পরিবহনের। সেটি ঢাকা থেকে মাগুরা যাচ্ছিল। অন্যদিকে ছোট ট্রাকটি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা থেকে আসছিল।
দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কানাইপুরের দিগনগর গ্রামের বাসিন্দা সাহানা বেগম বলেন, ঘটনাস্থলে আসার পর বাসটির একটি চাকা গর্তে পড়ে। এতে সেটি আড়াআড়িভাবে সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে যায়। এ সময় ছোট ট্রাক দ্রুতগতিতে এসে বাসের মাঝামাঝি আঘাত করে।
মারা যাওয়া সবাই ট্রাকের যাত্রী। তাঁদের মধ্যে ঘটনাস্থলে ১১ জন এবং ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে ৩ জন মারা যান। তাঁদের মধ্যে এক পরিবারের চারজন রয়েছেন। তাঁরা হলেন ফরিদপুরের বোয়ালমারীর বেজিডাঙ্গা গ্রামের রাকিবুল হাসান মোল্লা ওরফে মিলন (৩৫), তাঁর স্ত্রী শামীমা আক্তার ওরফে সুমি (২৩) এবং তাঁদের দুই ছেলে আলবি রোহান (৬) ও আবু সিনান (৩)।
রাকিবুল ঢাকায় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে লিফটম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটি শেষে তিনি পরিবারসহ ঢাকায় ফিরছিলেন। দুর্ঘটনায় রাকিবুলের মা হুবাইয়া বেগম (৬০) আহত হয়েছেন। তিনিসহ আরও কয়েকজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন মর্জিনা বেগম (৭৩), তবিবুর রহমান (৫৫), নজরুল ইসলাম (৩৫), জাহানারা বেগম (৪৫), সোনিয়া বেগম (২৮), নুরানী (২), কহিনুর বেগম (৬০), শুকুরুন্নেছা (৭০) ও সূর্য বেগম (৪০)। নিহত ব্যক্তিরা ফরিদপুরের বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা।
ফরিদপুর ফায়ার সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র বাড়ৈ প্রথম আলোকে বলেন, সকাল ৭টা ৫৩ মিনিটে তাঁরা খবর পেয়ে ৮টা ৩ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। সেখানে গিয়ে দেখতে পান ছোট ট্রাকের তিন যাত্রী মৃত অবস্থায় সড়কের ওপর পড়ে আছেন। ভেতরে অনেকে আটকা।
বিআরটিএ ও হাইওয়ে পুলিশ সূত্র বলছে, বেশি মৃত্যুর কারণ ট্রাকে যাত্রী পরিবহন। দুর্ঘটনার পরপরই যাত্রীদের বেশির ভাগ ট্রাক থেকে ছিটকে পড়েন। সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে, যাত্রীবাহী যানবাহনে নিরাপত্তাবেষ্টনী থাকা বাধ্যতামূলক। ট্রাকে যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ। দুর্ঘটনায় পড়া ট্রাকট্রিতেও বেষ্টনী ছিল না বলে প্রাণহানি বেশি হয়েছে বলে মনে করছেন সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।
২০১১ সালে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে স্কুলছাত্রদের বহনকারী একটি ট্রাক উল্টে ৪৪ শিক্ষার্থী মারা যায়। এরপর গঠিত তদন্ত কমিটি অধিক প্রাণহানির পেছনে খোলা ট্রাকে যাত্রী পরিবহনকে দায়ী করেছিল এবং ভবিষ্যতে এসব যানে যাত্রী পরিবহন বন্ধে কঠোর হওয়ার সুপারিশ করে। কিন্তু এখনো খোলা ট্রাক ও পিকআপের মতো যানবাহনে যাত্রী পরিবহন করা হয়। ঈদুল ফিতরের ছুটি শেষে মানুষ যখন ঢাকায় ফিরছেন, তখন সড়কে এসব পরিবহনে যাত্রী তোলা হচ্ছে। বাসে ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়ায় অনেকে বাধ্য হয়ে কম ভাড়ায় ট্রাকে চলাচল করছেন।
ফরিদপুরের দুর্ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসন পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। এতে জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি ছাড়াও বিআরটিএ, হাইওয়ে পুলিশ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রতিনিধিদের রাখা হয়েছে।
১১ দিনে ১৮৯ জনের মৃত্যু
বিআরটিএর হিসাবে, এবারের ঈদুল ফিতরে গতবারের চেয়ে সড়কে বেশি প্রাণহানি হয়েছে। দুর্ঘটনার সংখ্যাও এবার বেশি। ৪ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ঈদুল ফিতরের আগে ও পরের ১১ দিনে সারা দেশে ১৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮৯ জন মারা গেছেন। অর্থাৎ এ সময় প্রতিদিন গড়ে ১৭ জনের প্রাণ গেছে সড়কে। ১১ দিনে আহত হয়েছেন ২৭৮ জন।
অন্যদিকে গত বছর ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে ১১ দিনে ১৬১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছিল ১৫৩ জনের। অর্থাৎ সেই সময় প্রতিদিন গড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ১৪ জন। গতবার আহত হয়েছিলেন মোট ২৬৭ জন।
সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য সংরক্ষণ করে বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। সংস্থাটির হিসাবে, গত পাঁচ বছরে সারা দেশে সাড়ে ২৮ হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩১ হাজারের বেশি মানুষ। আহত হয়েছেন আরও প্রায় ৪৬ হাজার জন। এই পাঁচ বছরে প্রতিবছর গড়ে ছয় হাজারের বেশি মানুষ সড়কে প্রাণ হারিয়েছেন।
ফরিদপুরসহ গতকাল দেশের আট জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় আরও ১০ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার রামচন্দ্রপুর এলাকায় দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুজন মারা যান। ফরিদপুরের নগরকান্দায় গতকাল বিকেলে আরেক সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেলকে একটি গাড়ি চাপা দিলে মা-ছেলে নিহত হন এবং বাবা-মেয়ে আহত হন।
বাসটির সনদ নেই
ফরিদপুরে ইউনিক পরিবহনের যে বাসের (ঢাকা মেট্রো-ব ১১-১৭৫৯) সঙ্গে ছোট ট্রাকের সংঘর্ষ হয়েছে, সেই বাসের ফিটনেস সনদ ও কর পরিশোধের সনদ (ট্যাক্স টোকেন) নেই। বিআরটিএ সূত্র জানিয়েছে, ফিটনেস সনদ ছাড়াই তিন বছরের বেশি সময় ধরে বাসটি চলছিল। এটির ফিটনেস সনদ ২০২০ সালের পর আর হালনাগাদ করা হয়নি। আইন অনুসারে, ফিটনেসবিহীন যানবাহন চালালে দায়ীদের সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড ২৫ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, বাসটি সর্বশেষ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ট্যাক্স টোকেন হালনাগাদ করে, যার মেয়াদ শেষ হয় ২০২০ সালের নভেম্বরে। সড়ক পরিবহন আইনে মেয়াদোত্তীর্ণ ট্যাক্স টোকেন নিয়ে গাড়ি চালালে এক মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
দুর্ঘটনায় পড়া বাসটি রুট পারমিট (নির্দিষ্ট পথে চলাচলের অনুমতি) মানছিল না। এটি চলার অনুমোদন ছিল চট্টগ্রাম-বগুড়া পথে। যদিও সেটি চট্টগ্রাম-মাগুরা পথে চলাচল করছিল। অবশ্য চট্টগ্রাম-বগুড়া পথে চলাচলের অনুমোদনের মেয়াদও ২০২১ সালে পেরিয়ে গেছে। সড়ক পরিবহন আইনে এই অপরাধের জন্য তিন মাসের কারাদণ্ড বা ২০ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।
বিআরটিএ সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে সারা দেশে যানবাহন আছে ৬০ লাখের মতো। এর মধ্যে ৪৪ লাখের মতো মোটরসাইকেল। যার কোনো ফিটনেস সনদ দরকার হয় না। বাকি যে ১৬ লাখ যানবাহন রয়েছে, তার মধ্যে ৬ লাখ ১৮ হাজারের মতো যানের ফিটনেস সনদ হালনাগাদ নেই। অর্থাৎ ফিটনেস সনদ নেওয়া বাধ্যতামূলক যানবাহনের মধ্যে প্রায় ৩৯ শতাংশ এই সনদ ছাড়াই চলাচল করছে।
সড়ক পরিবহন আইনের একাধিক ধারা লঙ্ঘন করে এভাবে যানবাহন চলাচল করলে পুলিশ কিংবা বিআরটিএর ম্যাজিস্ট্রেটের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা।
সড়ক আইন বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা এবং সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর। সংখ্যায় কম হলেও সংস্থাটির নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট ও পরিদর্শক আছে। তাঁরা চাইলে দেশের যেকোনো স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পারেন।
মহাসড়কে আছে হাইওয়ে পুলিশ। ২০০৫ সালে হাইওয়ে পুলিশের যাত্রা শুরু হয়। এর কাজের মধ্যে রয়েছে অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, মহাসড়কে সড়ক আইনের প্রয়োগ, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা, যানবাহন নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। এ বাহিনীতে ২ হাজার ৮০০–এর মতো সদস্য রয়েছেন। সারা দেশে ৮০টির মতো থানা ও ফাঁড়ি রয়েছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সংস্থাটির জন্য যানবাহন, মহাসড়কে চলাচলরত যানবাহনের গতি পরিমাপের যন্ত্র ও ক্যামেরা রয়েছে।
অবশ্য বিটিআরটিএ ও হাইওয়ে পুলিশ জনবলের স্বল্পতা ও সরঞ্জামের অভাবকে দায়ী করে থাকে। বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষেত্রে বিআরটিএর সক্ষমতা সীমিত। সেই সীমিত সক্ষমতা দিয়ে সড়কে অনিয়ম দূর করতে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারের ফি বাবদ কিছু টাকা দিয়ে ফিটনেস সনদ নেওয়া যায়। মালিকেরা সেই ব্যয়টাও করতে চান না।
নূর মোহাম্মদ মজুমদার আরও বলেন, গতকালও বিআরটিএ ও জেলা প্রশাসন মিলে ৩০টির বেশি জায়গায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে। তবে সরকারের অন্যান্য সংস্থারও উচিত সড়কে অনিয়ম দূর করতে কঠোর হওয়া।
‘আইনের প্রয়োগ জরুরি’
বছরের পর বছর ধরে বিটিআরটিএ সীমিত সক্ষমতার কথা বলছে। অন্যদিকে দুর্ঘটনা বাড়ছে। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যানবাহনের সনদ নেই অথবা চালকের লাইসেন্স নেই। যানবাহনগুলো বেপরোয়া গতিতে চলাচল, চালককে বিশ্রাম না দেওয়া, পরিবহনশ্রমিকদের মাদকাসক্তির অভিযোগও রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এরআরআই) পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাকে যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ থাকার পরও কীভাবে তা মহাসড়কে চলাচল করছিল—এই প্রশ্নের আগে উত্তর দিতে হবে। এটা দেখার জন্য হাইওয়ে পুলিশ ও বিআরটিএ রয়েছে। এরপর ট্রাকের মালিক ও চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে এই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বন্ধ হবে না।
সামছুল হক আরও বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা না আনতে পারলে অনেক খরচ করে মহাসড়ক করে খুব একটা লাভ হবে না। এই উন্নয়ন হবে ত্রুটিপূর্ণ। ফলে আগে সড়কে আইনের প্রয়োগ জরুরি। শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করতে হবে।