চাঁদপুরে জলাভূমিতে মেডিকেল কলেজ, উদ্দেশ্য ‘বালু–বাণিজ্য’
চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের জন্য প্রস্তাবিত জমির অর্ধেকই জলাভূমি। পরিকল্পনা কমিশন বলছে, এ জমি ভরাট করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
চার বছর আগে সদর হাসপাতালকে অস্থায়ী ক্যাম্পাস বানিয়ে চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের যাত্রা শুরু হলেও স্থায়ী ক্যাম্পাস তৈরির কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির জন্য ডাকাতিয়া নদীর তীরে যে স্থান বাছাই করা হয়েছে, সেখানকার জমির একটা বড় অংশ জলাভূমি।
নদীর পারে এত নিচু এলাকায় হাসপাতালের জন্য জমি অধিগ্রহণে আপত্তি জানিয়ে পরিকল্পনা কমিশন বলছে, এই জমিতে স্থাপনা করতে হলে ১২ ফুট বা এর বেশি পরিমাণ বালু ভরাট করতে হবে। একই সঙ্গে নদী রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
অপর দিকে স্থানীয় লোকজন মনে করছেন, মেডিকেল কলেজের জন্য জলাভূমিতে স্থান নির্ধারণের নেপথ্যে ‘বালুদস্যুদের’ বড় বাণিজ্যিক স্বার্থ রয়েছে।
সরকারি প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে কারসাজির ঘটনা চাঁদপুরে এর আগেও ঘটেছে। গত বছর চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে জমি অধিগ্রহণে কারসাজি করে বাড়তি ৩৫৯ কোটি টাকা নেওয়ার চেষ্টা করে একটি প্রভাবশালী মহল।
সরকার চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ স্থাপন প্রকল্প গ্রহণ করে ২০১৮ সালে। ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি চাঁদপুর সদর হাসপাতালে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে এই কলেজের যাত্রা শুরু হয়। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের এ–সংক্রান্ত নথিপত্র অনুযায়ী, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য চাঁদপুর শহরের মহাদেব গাছতলা মৌজায় ৩০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব করেছে কর্তৃপক্ষ। এই জমির মধ্যে ২৮ একর ব্যক্তিমালিকানাধীন। বাকি ২ একর সরকারি সম্পত্তি।
এসব নিচু জমি বাছাই করার কারণ হিসেবে এলাকায় দুটি বিষয় আলোচনায় রয়েছে। সেটা হচ্ছে, এই জমি অধিগ্রহণ করা হলে সেখানে বিশাল ‘বালু–বাণিজ্য’ হবে। অধিগ্রহণের আগে জমি কেনাবেচায় এক দফা বাণিজ্য হবে।
সরকারি তথ্য বলছে, এ প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের জন্য খরচ ধরা হয়েছে প্রায় দেড় শ কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় আবাসিক-অনাবাসিক মিলিয়ে মোট ভবন হবে ২২টি। এ জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৯৩৮ কোটি টাকা। মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনাকাটা বাবদ ১২৫ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে। এসব ব্যয়ের প্রস্তাব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই এই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন করানোর জন্য একটি মহল থেকে চেষ্টা-তদবির চলছে। আগামী মাসে একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য উত্থাপনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানিয়েছে।
প্রকল্পকে ঘিরে জমি কেনাবেচা ও বালু–বাণিজ্যের ঘটনা প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় শোনা যায়। একটা সংস্কৃতি হয়ে গেছে। জবাবদিহির ঘাটতিতে বারবার একই ঘটনা ঘটছে।ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি
সরেজমিন চিত্র
২৩ আগস্ট প্রকল্প এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, প্রস্তাবিত জমির প্রায় অর্ধেক জলাভূমি, মূল রাস্তা থেকে প্রায় ১২ ফুট নিচে। সেখানে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ শাজাহানের সঙ্গে। তিনি একটি ইটভাটায় কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘শুনেছি, মহাদেব গাছতলা মৌজায় একটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল হবে। নদীর পারের এই জমি অধিগ্রহণ করলে সেটা ভরাট করতে প্রচুর বালুর প্রয়োজন হবে।’
প্রকল্প এলাকায় ৩ একর জমি আছে মিজানুর রহমানের পরিবারের। তাঁর দাবি, ওই জমি অধিগ্রহণ করলে পুরো পরিবার ভূমিহীন হয়ে যাবে। তিনি মনে করেন, নদীর পারের জমি অধিগ্রহণ না করে সমতল এলাকায় মেডিকেল কলেজ করার সুযোগ আছে।
তবে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) কাজী আফজালুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প করতে গেলে ভূমির উন্নয়ন করতে হয়। এখানেও বালু ফেলতে হবে।
নদীর তীরভূমি এলাকায় কোনো স্থাপনা করতে হলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) অনুমোদন নিতে হয়। বিআইডব্লিউটিএর চাঁদপুরের উপপরিচালক শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত অনুমোদনের জন্য তাঁদের কাছে কেউ আসেননি।
‘৩০ একর জমি অধিগ্রহণ আমাদের প্রস্তাব। একনেক যদি মনে করে ৩০ একর জমির দরকার নেই, তাহলে আমরা জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে আনব।’কাজী আফজালুর রহমান, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক
গোপনে চলছে জমি কেনাবেচা
ওই এলাকায় গিয়ে জানা যায়, এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে প্রস্তাবিত এলাকায় গোপনে জমি কেনাবেচা চলছে। এখন জমি কিনে রেখে সরকারের কাছ থেকে তিন গুণ দামে বিক্রির পরিকল্পনা করছেন কেউ কেউ। তবে চলতি বছর ওই মৌজায় কী পরিমাণ জমি কেনাবেচা হয়েছে, তা জানতে এই প্রতিবেদক গত বুধবার চাঁদপুর সাবরেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে যায়। কিন্তু সেখানকার কেউ এই বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
পরে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র থেকে কয়েকটি জমির দলিলের অনুলিপি সংগ্রহ করা গেছে। তাতে দেখা যায়, মহাদেব গাছতলা মৌজায় প্রকল্প এলাকায় গত তিন মাসে কিছু জমি কিনেছেন স্থানীয় লিটন পাঠান। তিনি মূলত বালু ব্যবসায়ী। প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকার ঠিক উল্টো পাশে তাঁর বালু ব্যবসার অফিস। ডাকাতিয়া সেতুর পাশে বিশাল এলাকাজুড়ে উঁচু করে রাখা বালু।
লিটন পাঠান দাবি করেন, তিনি ১০ শতাংশ জমি কিনেছেন। তাঁর আত্মীয়স্বজন থেকে এসব জমি কিনেছেন। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে জানা যায়, সরকারি নথিতে প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট যেসব তথ্য আছে, সবই তাঁর জানা।
গত তিন মাসে সেখানে জমি কেনার তালিকায় আছেন নূরুল ইসলাম শেখ, আবুল কালাম গাজী, আমির হোসেনসহ অনেকের নাম।
এখন পর্যন্ত অনুমোদনের জন্য তাঁদের কাছে কেউ আসেননি।শাহাদাত হোসেন, বিআইডব্লিউটিএর চাঁদপুরের উপপরিচালক
পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদন
এই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য প্রস্তাবিত জমি সরেজমিন দেখতে গত জুনে চাঁদপুরে যায় পরিকল্পনা কমিশনের একটি প্রতিনিধিদল। পরিদর্শন শেষে প্রতিনিধিদল একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য ৩০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ একর জলাভূমি, যা বর্ষাকালে প্লাবিত থাকে। এই ১৪ একরে স্থাপনা নির্মাণ করতে হলে ১২ ফুট বা এর বেশি পরিমাণ বালু ভরাট করতে হবে। একই সঙ্গে নদী রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
পরিকল্পনা কমিশনের মতামত হচ্ছে, অবশিষ্ট যে ১৬ একর জমি রয়েছে, সেখানে সরাসরি স্থাপনা করা যাবে। এই জমিতেই প্রকল্পটি করা সম্ভব। এতে জমি অধিগ্রহণের খরচ কমবে। একই সঙ্গে মানুষের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণের ঝামেলাও কমবে। পরিকল্পনা কমিশনের একটি সূত্র বলছে, একনেক সভায় কী সিদ্ধান্ত হয়, সেটাই দেখার বিষয়।
তবে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক কাজী আফজালুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘৩০ একর জমি অধিগ্রহণ আমাদের প্রস্তাব। একনেক যদি মনে করে ৩০ একর জমির দরকার নেই, তাহলে আমরা জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে আনব।’ তিনি বলেন, সামনে যেসব মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য স্থাপনা করা হবে, সেখানে জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ কমে আসবে।
শুনেছি, মহাদেব গাছতলা মৌজায় একটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল হবে। নদীর পারের এই জমি অধিগ্রহণ করলে সেটা ভরাট করতে প্রচুর বালুর প্রয়োজন হবে।
আসলে কত জমি দরকার
দেশে কয়েকটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্প পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জমি অধিগ্রহণে কোনো শৃঙ্খলা নেই। যে যার মতো করে জমি অধিগ্রহণ করছে। এসব প্রকল্প সামনে রেখে আগে জমি কিনে রেখে লাভবান হচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী।
গত জুনে একনেক সভায় পাস হওয়া রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে ৬৮ একর। সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে ৮৭ একর।
প্রস্তাবিত খুলনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৫০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপিত হয়েছে ১৫ একর জমিতে। চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করা হচ্ছে ২৩ একর জমিতে। আর চাঁদপুরে প্রস্তাব করা হয়েছে ৩০ একর।
অতীতেও কারসাজি
সরকারি প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে কারসাজির ঘটনা চাঁদপুরে এর আগেও ঘটেছে। গত বছর চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে জমি অধিগ্রহণে কারসাজি করে বাড়তি ৩৫৯ কোটি টাকা নেওয়ার চেষ্টা করে একটি প্রভাবশালী মহল। অধিগ্রহণের আগে সেখানকার সাড়ে ৬২ একর জমি মৌজা দরের চেয়ে ২০ গুণ বেশি দাম দেখিয়ে দলিল করে নেয় ওই মহল। এ নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রথম আলো। যে জেলা প্রশাসক ওই কারসাজি নিয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন, তাঁকে পরে বদলি করে দেওয়া হয়। যদিও ওই প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ পরবর্তী সময়ে আটকে যায়।
এখন সেখানে মেডিকেল কলেজের জন্য স্থান বাছাই নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, চাঁদপুরের মতো জেলায় মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ ইতিবাচক। কিন্তু মূল উদ্দেশ্যকে পুঁজি করে একটি শ্রেণি যোগসাজশ করে তাদের সম্পদ বিকাশের চেষ্টা করছে। জনগণ যেখানে উপকৃত হবে, সেখানে প্রতিষ্ঠানটি করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, প্রকল্পকে ঘিরে জমি কেনাবেচা ও বালু–বাণিজ্যের ঘটনা প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় শোনা যায়। একটা সংস্কৃতি হয়ে গেছে। জবাবদিহির ঘাটতিতে বারবার একই ঘটনা ঘটছে।