স্বর্ণ জয়ের স্বপ্ন নিয়ে ইংল্যান্ডে যাচ্ছে খুদে গণিতবিদেরা

বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আয়োজকদের সঙ্গে ছয় খুদে গণিতবিদ (দাঁড়িয়ে বাঁ থেকে) এস এম এ নাহিয়ান, মনামী জামান, জিতেন্দ্র বড়ুয়া, তাহসিন খান, মো. নাফিজ নূর তাস্বীন এবং মুসাহিদ আহমদ। ঢাকা, ১১ জুলাইছবি: খালেদ সরকার

সোনা জয়ের স্বপ্ন নিয়ে মেধার যুদ্ধে অংশ নিতে ইংল্যান্ডে যাচ্ছে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড দল। আজ বৃহস্পতিবার ছয় সদস্যের খুদে গণিতবিদদের এই দলকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। দেশের ভেতরে প্রায় ৭১ হাজার পরীক্ষার্থীর সঙ্গে মেধার যুদ্ধে লড়ে এই খুদে গণিতবিদেরা জায়গা করে নিয়েছে অলিম্পিয়াডের মূল দলে।

এখন এই খুদে গণিতবিদেরা আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের (আইএমও) চূড়ান্ত পর্বে পদক জয়ের জন্য লড়বে বিশ্বের সেরা খুদে গণিতবিদদের সঙ্গে। ১৫ জুলাই থেকে ইংল্যান্ডের বাথ শহরে অনুষ্ঠিত হবে এবারের গণিত অলিম্পিয়াড।

আজ বিকেলে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি এবারের গণিত অলিম্পিয়াড দলের সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির আয়োজনে সারা দেশে গণিত উৎসব আয়োজিত হচ্ছে। প্রথম আলোর বিজ্ঞান প্রজন্ম পাতায় ২০০১ সালে ‘নিউরনে অনুরণন’ নামের যে আয়োজন শুরু হয়েছিল, সেটিই সারা দেশে এখন গণিত উৎসব নামে পেয়েছে বিপুল জনপ্রিয়তা। শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণিতভীতি কাটিয়ে গণিতকে উৎসবের বিষয় করে তুলতে প্রতিবছর প্রাক্‌–বিশ্ববিদ্যালয় পর্বের শিক্ষার্থীদের নিয়ে চলছে ‘ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত উৎসব’।

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সভাপতি বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, এ বছর গণিত উৎসবে অংশ নিতে সারা দেশের ৭১ হাজার শিক্ষার্থী অনলাইনে নিবন্ধন করে। অনলাইনে বাছাই পরীক্ষার পর উত্তীর্ণদের নিয়ে ১৮টি শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা। সেখান থেকে ১ হাজার ৩৫০ জন আঞ্চলিক বিজয়ীকে নিয়ে ঢাকায় হয়েছে জাতীয় উৎসব। সেখানে বিজয়ী ৮৫ জনকে নিয়ে বাছাই পরীক্ষার পর উত্তীর্ণ ৪০ জনকে নিয়ে শুরু হয় গণিত অলিম্পিয়াড ক্যাম্প। এ ক্যাম্পে ধাপে ধাপে এশিয়ান-প্যাসিফিক গণিত অলিম্পিয়াড ও আইএমও নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সেরা ৬ জনকে নিয়ে গণিত অলিম্পিয়াডের মূল দল গঠন করা হয়েছে। আইএমও নিয়ম অনুসারে একটি দেশ থেকে সর্বোচ্চ ছয়জন চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে।

মোহাম্মদ কায়কোবাদ জানান, ১৯৫৯ সালে রোমানিয়ায় শুরু হয়েছিল সারা বিশ্বের প্রাক্‌–বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে গণিত অলিম্পিয়াড। এবার ১৫ থেকে ২১ জুলাই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ৬৫তম অলিম্পিয়াড। এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশের প্রায় ৬০০ প্রতিযোগী অংশ নিচ্ছে। বাংলাদেশ দল যাত্রা করবে ১৪ জুলাই। এবার স্বর্ণপদক জয়ের প্রত্যাশা নিয়েই যাচ্ছে তারা।

সভাপতি এবারের আইএমও দলের সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেন। দলের একমাত্র মেয়ে সদস্য ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মনামী জামান। অপর সদস্যরা হলো চট্টগ্রাম বাকলিয়া সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির জিতেন্দ্র বড়ুয়া, ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের দশম শ্রেণির তাহসিন খান, ঢাকার বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের একাদশ শ্রেনির মো. নাফিজ নূর, বরিশাল ক্যাডেট কলেজের একাদশ শ্রেণির মুসাহিদ আহমদ ও ঢাকা কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী এস এম এ নাহিয়ান।

অনুষ্ঠানে অলিম্পিয়াড দলের সদস্যদের শুভেচ্ছা ও সাফল্য কামনা করে ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন, প্রায় ২০ বছর ধরে ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক প্রথম আলোর সঙ্গে থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীদের গণিত উৎসবে সহায়তা দিচ্ছে। তারা একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হলেও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে জনকল্যাণমূলক কাজে আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। এ পর্যন্ত ১ হাজার ১০৪ কোটি টাকা তারা সমাজকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুদান রয়েছে শিক্ষা খাতে—৫৬৮ কোটি টাকা। ব্যাংকটি শিক্ষার্থীদের সহায়তা দেওয়া অব্যাহত রাখবে।

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান শিক্ষার্থীদের বলেন, প্রথম আলো সারা বছর বিভিন্ন আয়োজন করে। গণিত উৎসব এসবের মধ্যে প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, এই মেধাবী সন্তানদের মা–বাবা, শিক্ষকেরা অনেক পরিশ্রম করে তাদের বড় করে তোলেন। তাঁদের তিনি ধন্যবাদ জানান। খুদে গণিতবিদদের অনুপ্রেরণা দিয়ে বলেন, ‘সব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে তোমরা স্বপ্নপূরণের পথে সাধ্যমতো সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবে। তোমাদের সাফল্য সারা দেশে আনন্দ উৎসবের উৎস হয়ে উঠবে, এটাই প্রত্যাশা।’

শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা দিয়ে তাদের সাফল্য কামনা করে বক্তব্য দেন গণিত অলিম্পিয়াডের সহসভাপতি বুয়েটের গণিতের অধ্যাপক আবদুল হাকিম খান, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক হায়দার আলী বিশ্বাস, ঢাকা সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষক প্রশিক্ষক রাজিয়া বেগম, বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রিজওয়ানা রিয়াজ ও রিভ সিস্টেমের পরিচালক আজমত ইকবাল। সঞ্চালনা করেন গণিত অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদক ও প্রথম আলোর যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক মুনির হাসান। সংবাদ সম্মেলনে অলিম্পিয়াড দলে ছয় সদস্যের মা–বাবা ও শিক্ষকদের অনেকে এবং গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ ২০০৪ সালে আইএমওর সদস্য পদ লাভ করে এবং ২০০৫ সাল থেকে নিয়মিত চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। শুধু অংশ নেওয়ার জন্যই অংশ নেওয়া বা অভিজ্ঞতা লাভের জন্য অংশ গ্রহণ নয়। গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের সোনালি সাফল্য বয়ে এনেছে খুদে গণিতবিদেরা। গত ১৯ বছরে মেধাবী তরুণেরা ১টি স্বর্ণ, ৭টি রৌপ্য, ৩৫টি ব্রোঞ্জসহ মোট ৪৩টি পদক এবং আরও ৪০টি সম্মাননা স্বীকৃতি অর্জন করে গণিতের বিশ্বসভায় দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে।