৩০ বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতি
রাষ্ট্র ও রাজনীতির ধর্মাশ্রয়ী নীতি সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের জন্য দায়ী
পঞ্চগড় শহরের পাশে আহম্মদনগর এলাকায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ ও আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের বিশিষ্ট ৩০ নাগরিক। একই সঙ্গে তাঁরা নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রতি সংহতি জানান।
দেশের সচেতন নাগরিক সমাজের পক্ষে আজ শনিবার দেওয়া বিবৃতিতে বিশিষ্ট নাগরিকেরা বলেন, ধর্মীয় উগ্র পন্থার অপ্রতিরোধ্য আগ্রাসনেও রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা দেশে ধর্ম ও জাতিগত নিপীড়নপ্রবণতা সৃষ্টির জন্য দায়ী। রাষ্ট্র ও রাজনীতির ধর্মাশ্রয়ী নীতি প্রতিটি সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের জন্য দায়ী। আহমদিয়া সম্প্রদায় কিংবা অন্যান্য ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীর ওপর ইতিপূর্বে সংঘটিত নিপীড়নের ঘটনায় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হলে স্বাধীনতার মাসে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।
বিবৃতিতে বিশিষ্ট নাগরিকেরা চারটি দাবি তুলে ধরে বলেন, প্রতিটি সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ—এটিকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি ঘটনায় সংসদীয় তদন্ত কমিশন ও স্বাধীন গণতদন্ত কমিশন গঠনের বাধ্যবাধকতা প্রতিষ্ঠায় আইন প্রণয়ন করতে হবে। সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের ঘটনার বিচারে সব মামলা দ্রুত বিচার আইনে ও সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। এযাবৎ সংঘটিত সব সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের বিচার করতে হবে। একই সঙ্গে পঞ্চগড়ের আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বসতিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জড়িত সবাইকে দ্রুত গ্রেপ্তার ও সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনার তদন্ত এবং বিবৃতি প্রকাশ করতে হবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, পঞ্চগড়ের এই আক্রমণের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। ২০১৯ সালেও এভাবে আহমদিয়া সম্প্রদায় আক্রান্ত হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার সাংবিধানিক নীতি ও ধর্ম, বৈষম্য না করা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। শুধু আহমদিয়া সম্প্রদায়ই নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় অন্যান্য সংখ্যালঘু ধর্মীয় বা ভিন্নমতাবলম্বী ব্যক্তি–জনগোষ্ঠী একইভাবে উগ্র ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হয়ে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের আক্রমণপ্রবণতা বেড়েই চলেছে। রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টিসহ বাংলাদেশকে ক্রমশ ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতাবলম্বীর জন্য ভীতিকর রাষ্ট্রে পরিণত করছে, যা জনযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার নীতিকে কলঙ্কিত করছে।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে ৩০ বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতি দেওয়ার তথ্য জানানো হয়েছে। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল ও রাশেদা কে চৌধূরী, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য রামেন্দু মজুমদার, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতি সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত, মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদবিরোধী মঞ্চের সদস্য সচিব নুর মোহাম্মদ তালুকদার, মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এম এম আকাশ প্রমুখ।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন ও ঘটনাস্থলে কয়েক দিনের পুলিশি পাহারা বসিয়ে রাষ্ট্রীয় দায় শেষ করার বিপরীতে রাষ্ট্রকে কঠোর নীতি অনুসরণ করতে হবে। সব ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষের জন্য মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র তথা সরকারকে ধর্মবোধের রাজনীতি থেকে মুক্ত হয়ে কঠোরভাবে ধর্মীয় উগ্রতা ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করতে হবে।
আসকের নিন্দা
পঞ্চগড়ের ওই ঘটনায় নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে আসক।
একই সঙ্গে আসক আহমদিয়া সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে।
আসকের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খানের সই করা এক বিবৃতিতে বলা হয়, বিগত দিনেও আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর নজিরবিহীন মামলার ঘটনা ঘটেছে। একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর এ ধরনের হামলার ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পাশাপাশি এ ধরনের আচরণ নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল।