সুন্দরবন পুড়লে কার লাভ কার ক্ষতি
‘জঙ্গল আমাগো মায়ের মতোন, আমাগো বাঁচায়। জঙ্গল না থাকলি হবে? এক ঝড়েই তো সব উড়ায় নিয়া যাবে।’ সুন্দরবন নিয়ে এভাবেই ভালোবাসার কথা বলছিলেন বন–সংলগ্ন মধ্য আমোরবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা বাশার হাওলাদার (৭১)। ঝড়ঝঞ্ঝায় শুধু রক্ষাকবচ নয়; সুন্দরবন তাঁদের জীবন-জীবিকার অংশ। সম্প্রতি সেই বনে আগুন লেগে সাড়ে পাঁচ একর বনভূমি পুড়ে গেছে। গাছগাছালির পোড়া ছাইয়ে সবুজ বনের বুকে এখন দগদগে ক্ষত।
সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ড এবারই প্রথম নয়। গত ২৩ বছরে অন্তত ২৫টি অগ্নিকাণ্ডে এভাবে শত একর বনভূমি পুড়েছে। প্রতিবারই আগুন লাগে লোকালয়-সংলগ্ন বনের পূর্বাংশে। অংশটি ভোলা নদীর তীরে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জে পড়েছে।
আগের ২৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বন বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদনে আগুনের সূত্রপাতের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ১৫ বার ‘অসাবধানতাবশত বনজীবীদের ফেলে যাওয়া আগুনের কথা’ উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ জেলে ও মৌয়ালদের বিড়ি-সিগারেট বা মধু সংগ্রহের সময় মৌমাছি তাড়ানোর ধোঁয়ার মশাল থেকে আগুন লেগেছে। বনজীবীদের এমন কর্মকাণ্ডে বন বিভাগের উদাসীনতার দিকে আঙুল তুলেছেন স্থানীয় লোকজন।
* শ্বাসমূল পরিষ্কার করার জন্য শুষ্ক মৌসুমে কিছুদিন পরপর বনে আগুন দেয় দুষ্কৃতকারীরা। * বর্ষাকাল ছাড়া বনভূমিতে জোয়ারের পানি না ওঠায় দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
বন-সংলগ্ন গ্রামের বাসিন্দারা বলছেন, কিছু অসাধু মানুষ আছেন, যাঁদের আশকারা দেয় বন বিভাগ। বন বিভাগের লোকজন টাকা নিয়ে তাঁদের বনে ঢোকার অবৈধ সুবিধা দেয়। বন-সংলগ্ন মধ্য আমোরবুনিয়া গ্রামের শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চাই জঙ্গল যেন জীবিত থাহে। হ্যার জন্য যা করা লাগে, তাই করেন।’
আমোরবুনিয়া গ্রামের আরেক বাসিন্দা বিষয়টি ভেঙে বললেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘কিছু লোক লোভ সামলাইতে পারে না। তাঁরা ভাবে শুকনা মৌসুমে যদি আমরা এভাবে একটা কাজ (আগুন দেওয়া) করতে পারি, তাহলে বৃষ্টির সিজনে কিছু মাছ পাব। এ জন্য তারা এই কাজগুলো (আগুন) করে।’
স্থানীয় নিশানবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলামও একই ধরনের মন্তব্য করেন। অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ওই দুষ্কৃতকারীদের বিষয়টি উঠে এসেছে। অন্তত পাঁচটি প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডের কারণ হিসেবে পাঁচবার ‘মাছ মারার সুবিধার জন্য দুষ্কৃতকারীরা আগুন দিতে পারে’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
শ্বাসমূলীয় বন হিসেবে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলে দিনে-রাতে জোয়ারে দুবার প্লাবিত হয়। ব্যতিক্রম শুধু ধানসাগর ও জিউধারা এলাকা। স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, বর্ষায় ওই এলাকা ডুবে যায়। তার আগে শুষ্ক মৌসুমে দুষ্কৃতকারীরা আগুন দিলে বড় বড় গাছ মারা যায়। তখন বড় বড় গর্ত তৈরি হয়, যাতে বর্ষায় পানি জমলে শিং, কই, মাগুরসহ নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। ছাই ও পাতার পোড়া জৈব অংশে খাবারের খোঁজে মাছ ওপরে উঠে আসে। তখন প্রভাবশালীরা সেখানে মাছ ধরেন।
আগুনের সূত্রপাত যে কারণেই হোক, শুকনা বনাঞ্চলের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, সুন্দরবনের ধানসাগর, আমোরবুনিয়া, জিউধরা অঞ্চলটি প্রাকৃতিকভাবে উঁচু হয়ে গেছে। বর্ষাকাল ছাড়া সেখানকার খালের জোয়ারের পানি বনভূমিতে ওঠে না। শীত ও গ্রীষ্মে প্রতিবছর শুকনা পাতা পড়ে বনভূমিতে একটি স্তর তৈরি হয়। সেটি তুষের মতো কাজ করে। এ জন্য আগুন লাগলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
উঁচু বনভূমি ও সুন্দরবনের নদী-খাল শুকিয়ে যাওয়ায় বনে পানি ঢুকতে পারে না। সংকট নিরসনে নদী-খাল খননের উদ্যোগ নিয়েও সুফল মিলছে না। কারণ, খননের পর অপরিকল্পিতভাবে মাটি দুই পাড়ে স্তূপ রাখায় তা বাঁধের কাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে শুষ্ক মৌসুমের উঁচু জোয়ারেও (ভরাকটাল) বনে পানি ঢুকতে পারে না। অন্যদিকে নদীর স্বাভাবিক প্লাবনভূমি নষ্ট হয়ে নদী-খালে দ্রুত পলি জমছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ও ‘সুন্দরবন রক্ষায় আমরা’র সমন্বয়কারী মো. নূর আলম শেখ।
সুন্দরবনে বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে গত মঙ্গলবার মোংলা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে নূর আলম বলেন, আগুনে গাছপালার সঙ্গে প্রাণিকুলের আবাস ও প্রজননস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অসৎ বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মুনাফালোভী মাছ ব্যবসায়ীরা আগুন লাগাচ্ছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন।
অগ্নিকাণ্ড রোধ ও সুন্দরবনের এই অংশে শ্বাসমূলীয় বনের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে নদী-খাল খননের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই এলাকায় নদী-খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছে বন বিভাগ। এর আগে ভোলা নদী খননের পর মাটি পাড়ে ফেলায় বাঁধের মতো হয়ে যায়।
খনন আগের মতো অপরিকল্পিত হলে বিপদ বাড়তে পারে বলে মনে করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক মো. ওয়াসিউল ইসলাম। তিনি বলেন, অপরিকল্পিত খননে বনে জোয়ার-ভাটা বাধাগ্রস্ত হয়। সেখানকার ভূমি শুষ্ক থাকে। বর্ষার আগে আগে আরও শুকিয়ে যায়। এতে সহজে আগুন লাগে।
বনের নদী-খাল ঠিক রাখতে গেলে বন-সংলগ্ন এলাকার নদী-খালের প্রবাহ বাধাহীন করতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের ভাষ্য, নদী-খালের পানি প্রবাহের একটি ইকো সিস্টেম আছে। একটির প্রবাহ ঠিক না থাকলে অন্যগুলোতেও প্রবাহ কমে যায়।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, পরিবেশসম্মতভাবে খনন করতে হবে। খননের মাটি বনে বা পাড়ে ফেলা যাবে না। আবার ঢালাওভাবে খনন করা যাবে না। যেখানে জরুরি সেখানে খনন করা যেতে পারে। মাটিগুলো টাগবোট দিয়ে দূরে মূলভূমিতে ফেলতে হবে। তিনি বলেন, প্রাকৃতিকভাবে সুন্দরবনের পূর্বাঞ্চল একটু উঁচু। সেখানে পাড়ে মাটি ফেললে জোয়ারের পানি বনে ঢুকবে না।
অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে এই অধ্যাপক বলেন, তদন্ত কমিটিতে শুধু বন বিভাগ না, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে নিয়ে হওয়া উচিত। এর মাধ্যমে সঠিক কারণ বেরিয়ে আসবে। কিন্তু যাঁর দায়িত্ব রক্ষণাবেক্ষণের, তিনি তদন্ত করলে তাঁর অবহেলা সামনে আসবে না। এটা মনুষ্যসৃষ্ট আগুন। মৌয়াল, বনজীবীদের জীবিকা যেখানে জড়িত, তাঁরা এটি করবেন না। এটা অতি মুনাফালোভীদের কাজ। কারণ, বনে কিছু জায়গায় আগুন দিয়ে শ্বাসমূল পরিষ্কার করতে পারলে বর্ষায় মাছ ধরা সুবিধা। এ জন্য কিছুদিন পরপর দুষ্কৃতকারীরা আগুন দেয়।