ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম
এবার ২৫০০ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প নিতে তোড়জোড়
গত ১২ বছরে ৩৫২ কোটি টাকা ব্যয় করে শিশুশ্রম নিরসনে কোনো সুফল মেলেনি। উল্টো গত এক দশকে প্রায় এক লাখ শিশুশ্রমিক বেড়েছে।
দেশে কোনোভাবেই শিশুশ্রম বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধ হচ্ছে না। সরকার বিভিন্ন সময় শিশুশ্রম বন্ধে নানা প্রকল্প নিয়েছে, গত ১২ বছরে ৩৫২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। অথচ খোদ সরকারি জরিপ বলছে, নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও গত এক দশকে দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কমেনি, উল্টো বেড়েছে। এরই মধ্যে সরকার নতুন করে আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিচ্ছে।
সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে দেশকে শিশুশ্রমমুক্ত করতে চায়। এ জন্য ২০২১ সালে পাঁচ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এ পরিকল্পনার আওতায় দুই উপায়ে শিশুশ্রম নিরসন করতে চায়। এর একটি হচ্ছে খাতভিত্তিক শিশুশ্রম নিরসন, অন্যটি হচ্ছে এলাকাভিত্তিক। কিন্তু গত তিন বছরে কোথাও এই উদ্যোগ কার্যকর করা হয়নি।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ঝুঁকিমুক্ত কাজের মাধ্যমে আয়ের পথ করে দিতে ২০১৮ সালে ২৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন (চতুর্থ পর্যায়)’ নামে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পের আওতায় ১ লাখ শিশুকে ৯টি বিষয়ের ওপর ছয় মাসের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং চার মাসের দক্ষতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে এ প্রকল্পে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। ফলে এসব শিশুকে ঝুঁকিমুক্ত কাজে ফেরানো যায়নি।
এর আগে ২০১২ সালে ৬৮ কোটি টাকার ‘বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন (তৃতীয় পর্যায়)’ নামে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। ওই প্রকল্পে ৫০ হাজার শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে ফিরিয়ে আনতে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।
তারও আগে শিশুশ্রম নিরসনে ২০০২-০৯ সাল পর্যন্ত দুই ধাপে ৪০ হাজার শিশুকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাসহ দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
এ অবস্থায় সরকার নতুন করে শিশুশ্রম নিরসনে আড়াই হাজার কোটি টাকার একটি বড় প্রকল্প নিচ্ছে। তবে প্রকল্পটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ঢাকা জেলার উপমহাপরিদর্শক এ কে এম সালাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, শিশুশ্রম নিরসনে সরকার বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। এসব প্রকল্পে কারিগরি ও ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ থাকবে। প্রকল্পগুলো সফলভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে শিশুশ্রম নিরসন সম্ভব হবে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা না গেলে এতেও সুফল মিলবে না। কারণ, আগের প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না করায় সরকারের কোনো কর্মসূচি তেমন কাজে আসেনি।
সর্বশেষ গত মার্চে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ–২০২২–এ বলা হয়েছে, এক দশকে দেশে শিশুশ্রমিক বেড়েছে প্রায় এক লাখ। দেশে এখন ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ শিশুশ্রমিক আছে। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯। আবার এদের প্রায় ১০ লাখ ৭০ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে।
ইনসিডিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাসুদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে প্রান্তিক শিশুদের নিয়ে চালানো নানা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অনেক শিশু স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে। তা ছাড়া অর্থনৈতিক মন্দার বিরূপ প্রভাবের কারণে অনেক দরিদ্র পরিবারের সন্তান শ্রমে নিয়োজিত হয়েছে। এতে শিশুশ্রমিক বেড়েছে।
ঢাকার উপকণ্ঠে শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে, নজর নেই
২৪ এপ্রিল ঢাকার কেরানীগঞ্জের জিনজিরার তাওয়াপট্টি এলাকায় গিয়ে একটি অ্যালুমিনিয়ামজাত পণ্যের কারখানায় কাজ করতে দেখা যায় ১৪ বছর বয়সী রমজানকে (ছদ্মনাম)। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সে সবার বড়। বাবা রিকশাচালক, মা গৃহিণী। কারখানায় সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সে কাজ করে। মাসে বেতন ৭ হাজার টাকা। তার বাবা জোর করে তাকে কাজে পাঠিয়েছেন।
রমজানের সঙ্গে একই কারখানায় আরও তিন শিশুকে কাজ করতে দেখা যায়।
তাওয়াপট্টি ও আশপাশের এলাকায় এক হাজারের বেশি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় পাঁচ শতাধিক শিশু কাজ করছে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় দুই বছর আগে ৪৩টি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তার প্রথমেই রয়েছে অ্যালুমিনিয়াম ও অ্যালুমিনিয়ামজাত পণ্য তৈরির কাজ। অ্যালুমিনিয়ামজাত পণ্যের কারখানায় কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের নিউমোনিয়া, কাশি, রক্তকাশি, আঙুলে দাদ (একজিমা), আঙুলে গ্যাংগ্রিনসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের তেলঘাট থেকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ধরে চর মীরেরবাগ পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ডকইয়ার্ড। এসব ডকইয়ার্ডকে কেন্দ্র করে এলাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য ওয়ার্কশপ। এসব ডকইয়ার্ড ও ওয়ার্কশপে শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে।
তেলঘাট এলাকার ১২ শিশুশ্রমিক, চারটি ওয়ার্কশপের মালিক এবং আট শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেন, এলাকার শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে সরানোর বিষয়ে সরকারি কোনো উদ্যোগের কথা তাঁরা জানেন না।
তাওয়াপট্টি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি আকতার জিলানি দাবি করেন, শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে সরিয়ে নিতে সরকার কখনো কোনো উদ্যোগ নিয়েছে, এমন তথ্য তিনি জানেন না।
এক খাত থেকে অন্য খাতে স্থানান্তর
তেলঘাট এলাকার একটি ডকইয়ার্ডে উত্তপ্ত চিমনির মুখে মবিল ঢালছিল ১৬ বছর বয়সী শিশু আরিফ (ছদ্মনাম)। আরিফ জানায়, সে দেড় বছর ধরে ডকইয়ার্ডে কাজ করছে। এর আগে স্থানীয় একটি পোশাক কারখানায় তিন বছর কাজ করেছিল। পারিবারের আর্থিক টানাপোড়েনে বাধ্য হয়ে সে ডকইয়ার্ডে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে।
আরিফের মতো অনেক শিশুশ্রমিক এক খাত থেকে অন্য খাতে স্থানান্তরিত হচ্ছে। বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নজরদারির কারণে ওই খাতের শিশুশ্রমিকেরা অপ্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন খাতে স্থানান্তরিত হয়।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ঢাকা জেলার উপমহাপরিদর্শক এ কে এম সালাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, শিশুশ্রমিক নিয়োগ দেয়, এমন প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সময় নোটিশ বা মামলা দিয়ে নিরুৎসাহিত করা হয়। কিন্তু এতে শিশুশ্রম নিরসন হচ্ছে না। এক খাতের শিশুশ্রমিক অন্য খাতে চলে যাচ্ছে। শিশুশ্রম স্থায়ীভাবে নিরসন করতে হলে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
নীতিমালা কার্যকর হয়নি, সুফল নিয়ে শঙ্কা
জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি-২০১০-এ বলা হয়েছে, শিশুশ্রমের প্রথম ও প্রধান কারণ অর্থনৈতিক দুরবস্থা। দ্বিতীয়ত, কোনো দরিদ্র পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষের মৃত্যু হলে শিশুর ভরণপোষণই দায় হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো শহরে এসে চরম দারিদ্র্যের মুখে পড়ে।
এসব কারণে দরিদ্র পরিবারের পক্ষে ভরণপোষণ মিটিয়ে সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালানো সম্ভব হয় না। তাই পরিবার বাধ্য হয়ে শিশুকে শ্রমে নিয়োজিত করে।
এসব পরিবারের শিশুদের শ্রম থেকে প্রত্যাহার ও দারিদ্র্যের চক্র থেকে বের করে আনার লক্ষ্যে মা–বাবাকে আয়বৃদ্ধিমূলক কাজে সম্পৃক্ত করা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের বিশেষ বিবেচনায় আনা, শিশুশ্রম নিরসনে আইন প্রণয়ন, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রণয়ন করাই এই নীতিমালার উদ্দেশ্য। তবে নীতিমালা প্রণয়নের ১৪ বছর পরও সেটি কার্যকর করা যায়নি।
অর্থাভাবে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া যাচ্ছে না
বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশন ২০২২ সালে কেরানীগঞ্জে শিশুশ্রমিকদের নিয়ে একটি জরিপ চালিয়েছিল। এতে দেখা যায়, ওই এলাকায় ১৫ হাজার শিশুশ্রমিক বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে। জরিপের উদ্দেশ্য ছিল, শিশুদের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। তবে অর্থাভাবে এসব শিশুকে শ্রম থেকে সরিয়ে আনা যায়নি।
বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা জেড এম কামরুল আনাম প্রথম আলোকে বলেন, শিশুদের পুনর্বাসন করতে জরিপে শিশুশ্রমিকের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। কিন্তু পুনর্বাসনে অর্থ লাগবে। সরকার বলেছে, নতুন প্রকল্পে পুনর্বাসনের বিষয়টি রাখা হবে। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।