আন্তর্জাতিক হতে পারেনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ২৩ বছর পূর্ণ হলো এ বছর। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মাতৃভাষা নিয়ে গবেষণার জন্য। তবে যাত্রার শুরু থেকে মসৃণভাবে এগোয়নি প্রতিষ্ঠানটির কাজ।
দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রভাবে নির্মাণপর্বের শুরুতেই পাঁচ বছর পুরোপুরি বন্ধ থেকেছে ইনস্টিটিউটের কাজ। এখন গবেষণা, গ্রন্থ প্রকাশ, জাদুঘর তৈরিসহ নানামুখী কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে মান অর্জন ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের সম্পর্ক গড়ে ওঠা প্রত্যাশিত ছিল, প্রতিষ্ঠানটি তা পূরণ করতে পারেনি।
যাত্রা শুরু
জাতিসংঘের শিক্ষা, গবেষণা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্মারক একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়। সে বছরের ৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপনের ঘোষণা দেন। তিনি ২০০১ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০০৩ সালে। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের কারণে পাঁচ বছর কাজ বন্ধ থাকে। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে আবার নির্মাণকাজ শুরু হয়। এরই মধ্যে পরিকল্পিত ১২ তলা ভবনের ৭ তলা পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে।
লক্ষ্য ও কাজ
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মূলত একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের সব মাতৃভাষা নিয়ে গবেষণাই এর মূল লক্ষ্য। পৃথিবীতে এখন টিকে থাকা মাতৃভাষার সংখ্যা প্রায় সাড়ে সাত হাজার। এর অনেকগুলো বিপন্ন। ইতিমধ্যে অনেক ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের কাজের পরিধি ব্যাপক। ভাষা প্রমিতকরণ, বিপন্ন বা বিলুপ্ত ভাষার গবেষণা ও সংরক্ষণ এবং শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা—এই তিন পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানটির কাজ করার কথা।
গত বছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক হাকিম আরিফ। তিনি বললেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে যে ভাষাগুলো কম বিকশিত বা বিপদাপন্ন, তাদের জিইয়ে রাখার ব্যবস্থা করা। ২০০১ সালে ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা হলেও গবেষণা কাজ শুরু হয়েছে ২০১০ সালে।
হাকিম আরিফ বললেন, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জন্য ১৩ বছর বেশি সময় নয়। আবার গবেষণার জন্য মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে দক্ষ জনবলের অভাব আছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যকে ভিত্তি করে যে কর্মপরিকল্পনা দরকার, সেটি সত্যিকার অর্থে করা হয়নি। ইনস্টিটিউটের যে জনবল কাঠামো দরকার সেটিও প্রকৃত অর্থে স্বীকৃত নয়। তিনি বলেন, ‘কতগুলো বিভাগ থাকবে, কত জনবল থাকবে সেটি আমি আসার পর নির্ধারণ করছি। বর্তমান কাঠামোতে ৯০টি পদ আছে। এর মধ্যে ৩৮টি পদই খালি।’
এখন তিনটি বিভাগে কাজ চলছে। পুরোপুরি কাজের জন্য মোটামুটি আটটি বিভাগ প্রস্তাব করা হয়েছে। আইসিটি থাকবে, অনুবাদ শাখা থাকবে, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ শাখা, এসব থাকবে। এখন কাজ চলছে প্রশাসন অর্থ ও প্রশিক্ষণ বিভাগ, ভাষা গবেষণা ও পরিকল্পনা বিভাগ এবং পাঠাগার, আর্কাইভ ও জাদুঘর বিভাগে।’
মহাপরিচালক নিজেই স্বীকার করলেন মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এখনো যথার্থভাবে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়নি। বললেন, ‘প্রতিবছরই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কিছু সংযোগ করা হচ্ছে। তবে তা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে যায়নি। এখন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আরও বাড়াতে হবে। আমাদের উদ্যোগ আছে। যেমন এবার সুইজারল্যান্ড বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক জর্জ বার্ন রিম এসেছেন। তিনি মূল প্রবন্ধ পড়বেন। আরও তিনজন ভাষাবিদ আসবেন।’
উদ্দেশ্যের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের বাস্তব অর্জন কতটুকু—প্রশ্নের জবাবে ইনস্টিটিউটের অতীত ও চলমান কাজের যে বিবরণ মহাপরিচালক হাকিম আরিফ দিয়েছেন তার সারসংক্ষেপ নিচে দেওয়া হলো।
দুই জাদুঘর
মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে দুটি জাদুঘর তৈরি করা হয়েছে। এর একটি ভাষা জাদুঘর। এত দিন এই জাদুঘর অস্থায়ী পর্যায়ে ছিল। এখন পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া হয়েছে। এখানে পৃথিবীর ১৯৯টি দেশের ভাষার নমুনা, জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত ও ছবি রয়েছে। জাদুঘরটি সবার জন্য উন্মুক্ত। আজ ২১ ফেব্রুয়ারি ইনস্টিটিউটের দোতলায় এই ভাষা জাদুঘর উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দ্বিতীয়টি হলো ভাষার লিখনরীতির আর্কাইভ। দীর্ঘ গবেষণা করে কাজটি করা হয়েছে। ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন ওই ভাষার লিখনরীতি। আর্কাইভে বিশ্বের ১৫২টি ভাষার লিখনরীতির বিস্তারিত বর্ণনা সংরক্ষণ করা হয়েছে। যেমন চীনা, রোমান, আরবি—এমন ১৫২ ভাষার লিখনরীতি ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। এটা পৃথিবীর একটি অনন্য আর্কাইভ।
এ ছাড়া ভাষা নিয়ে দেশ ও বিদেশের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে অনেকগুলো সেমিনার ও সভা হয়েছে। প্রকাশিত হচ্ছে জার্নাল।
নৃগোষ্ঠীর ভাষা সমীক্ষা
মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের একটি বড় কাজ হলো ‘বাংলাদেশের নৃগোষ্ঠীর বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা’। এটা ২০১৬ সালে শুরু হয়ে ২০১৮ সাল শেষ হয়েছে। দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত সমীক্ষায় ৪১টি ভাষা শনাক্ত করা হয়েছে।
এই ৪১টি ভাষার মাত্র আটটি ভাষার নিজস্ব লিপি আছে। এ ক্ষেত্রে যে ভাষাগুলোর লিপি নেই, সেই ভাষার লিপি তৈরি ও প্রবর্তন করা ইনস্টিটিউটের কাজ। এর পরের কাজ হলো বিপন্ন ভাষাগুলোর শব্দ সংখ্যা বাড়ানোর জন্য পরিভাষা তৈরি করা।
ভাষামাত্রই ব্যাকরণ আছে। লিপি তৈরির পরের কাজ সেই ভাষার ব্যাকরণ এবং অভিধান রচনা করা। অভিধান খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, অভিধান রচনা করলে ভাষা বেঁচে থাকে। এই কর্মপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। এরপর রয়েছে পাঠ্যপুস্তক রচনা ইত্যাদি।
এ ছাড়া বাংলাদেশে আরেক ধরনের ভাষা আছে। এগুলো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যেও ক্ষুদ্র। যেমন বেদেদের ভাষা। বেদে জনগোষ্ঠী যে ভাষায় কথা বলে তার নাম ‘ঠার’। এ ছাড়া আছে ডোমদের ভাষা। একে বলে ‘ডোম ভাষা’। বেদে ও ডোমদের অনেকেই মাতৃভাষা পরিবর্তন করে বাংলায় চলে এসেছেন। তাঁদের ভাষাও সংরক্ষণের কাজ চলছে।
মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের পরিকল্পনা রয়েছে, সমীক্ষার তথ্য ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে ১০ খণ্ড বাংলা ও ১০ খণ্ড ইংরেজি বই প্রকাশ করা। বাংলায় প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। বাকি ৯ খণ্ডের প্রকাশনার কাজ চলছে। ২০২৪ সালে একসঙ্গে ১০ খণ্ড আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে।
মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে, ১৯৫২ সালের মহান মাতৃভাষা আন্দোলনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভাষা নিয়ে যে ধরনের আন্দোলন হয়েছে তার তথ্য সংগ্রহ করে ভাষা আন্দোলনের একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করা, আর এ বিষয়ে একটি আর্কাইভ তৈরি করা।
নতুন উদ্যোগ
সম্প্রতি মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট একেবারেই নতুন কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর একটি হলো ‘বহুভাষী পকেট অভিধান’ তৈরি। এই প্রকল্পে পৃথিবীর প্রধান ১৬টি ভাষা নিয়ে আলাদা চারটি বই করা হবে। বইগুলো পকেটে রাখার মতো আকৃতি দিয়ে বের করা হবে। বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যান। অনেকে চাকরির সুবাদেও বিদেশ যাচ্ছেন। তাঁদের নিত্যদিনের ব্যবহারিক কাজে প্রয়োজন হয় এমন প্রায় দুই হাজার শব্দ থাকবে প্রতিটি বইয়ে। প্রথম বইটির মুদ্রণে প্রক্রিয়া চলছে। চলতি একুশে বইমেলাতেই আনুষ্ঠানিকভাবে বইটি প্রকাশ করার কথা রয়েছে।
অনুবাদ শাখা
অভিধান তৈরি করতে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে অনুবাদের জন্য একটি শাখা তৈরি করা হয়েছে। উন্নত ভাষার সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান বাংলা ভাষায় যুক্ত করা প্রয়োজন। একইভাবে বাংলা ভাষার সাহিত্য বিশ্বের উন্নত ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় ছড়িয়ে পড়া আবশ্যক। এর অংশ হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের নির্বাচিত গল্পের ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে। মুদ্রণ চলছে, এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হবে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ছয়টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। এটিরও প্রকাশনার কাজ চলছে।
মাতৃভাষা বিশ্বকোষ
মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের আরেকটি বড় কাজ হচ্ছে ‘মাতৃভাষা পিডিয়া’ বা মাতৃভাষা বিশ্বকোষ তৈরি। এই বিশ্বকোষে পৃথিবীর সব মাতৃভাষার অন্তর্ভুক্তি থাকবে। ভাষা সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য থাকবে। এই কাজ ইতিমধ্যেই অনেকটা এগিয়েছে। ২০২৪ সালে বিশ্বকোষ বাংলায় পাঁচ খণ্ডে ও ইংরেজিতে পাঁচ খণ্ডে প্রকাশ করা হবে।