ছায়ানটে এবারও সুরের মাধুরীতে বর্ষবরণের প্রস্তুতি
ধানমন্ডির ছায়ানট ভবনে শিক্ষার্থীদের মুখে যেন আনন্দের তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে। ঢাকা শহরে এখন দুঃসহ গরম। সেই গরম আর যানজট উপেক্ষা করে ঠিক সময়ে উপস্থিত হয়ে যাচ্ছে তারা মহড়ায়। ছুটির দিনে সকাল ১০টা আর অন্য দিনে বেলা তিনটা থেকে চলছে মহড়া। প্রায় আড়াই মাস আগে থেকে শুরু হয়েছে মহড়ার পালা; বাংলা নববর্ষ ১৪৩১–কে স্বাগত জানানোর এ প্রস্তুতি।
প্রতিবারের মতো এবারও রমনার বটমূলে সুরের মাধুরীতে নতুন বছরকে বরণ করবে ছায়ানট। ছায়ানটের শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থাকবেন দেশের গুণী শিল্পীরা। এই মঞ্চে গান গাওয়াটা শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন, বললেন ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক ও সংগীতশিল্পী লাইসা আহমেদ। হবে নাই–বা কেন? এর সঙ্গে যে জড়িয়ে আছে আত্মপরিচয়ের জন্য এ দেশের মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাস। লাইসা আহমদ প্রথম আলোকে বললেন, এবার শিল্পীদের অংশগ্রহণের সংখ্যা বেশি। প্রায় ১৭০ জন শিল্পী এবার অংশ নেবেন। যাঁরা গাইবেন, তাঁরা দীর্ঘ প্রক্রিয়া পার হয়ে এসেছেন। এখন চলছে শেষ দিকের মহড়া। এ সময়ের অনুশীলনের গুরুত্ব অনেক বেশি।
পরিবেশনার সব দিক মাথায় রেখেই যে অনুশীলন চলছে, তা বেশ বোঝা গেল। একবার সামান্য তাল বা লয় কাটলেই শুরু হচ্ছে আবার একেবারে প্রথম থেকে। সুরের বিচ্যুতি ঘটলে কনিষ্ঠতম শিল্পীটিও চেষ্টা করছেন শুধরে দিতে। সব ঠিক রাখার দায়িত্ব তাঁরও যেন কোনোভাবে কম নয়।
নালন্দা উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আনিসা মারিয়ামা হক এবার প্রথমবার গাইবে। আনিসা বলল, ছোটবেলা থেকে সে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান টেলিভিশনের পর্দায় দেখে আসছে। এবার অনুষ্ঠানে গাইবে। এ আনন্দের তুলনা নেই।
জাহরা রুবাইয়া হকও গাইবে প্রথমবারের মতো। জাহরা নালন্দার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছায়ানটের শিক্ষার্থী হয়েছে চার বছর আগে। জাহরা জানাল, সে মঞ্চে গাইবে বলে সেদিন পরিবারের সবাই মিলে যাবে রমনায়। বলল, ‘আমিও ফিরে এসে প্রথমেই রেকর্ডে দেখব, কেমন লাগছে দেখতে। এ আনন্দ কাউকে বলে বোঝানো যাবে না।’
বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে তাদের মতো এবার প্রথমবারের মতো গাইবেন প্রায় ৮০ জন। একক গান গাইবেন ১৮ জন শিল্পী। আর থাকবে কিছু একক পাঠ।
সম্মেলক গানের মহড়ার সময় শ্রোতার সারিতে বসে অপেক্ষা করছিলেন দেশের প্রথিতযশা শিল্পীরা। ছায়ানটের সহসভাপতি খায়রুল আনাম শাকিল তখন নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। এবার রমনার বটমূলে তাঁর পরিবেশন করার সম্ভাবনা আছে অজয় ভট্টাচার্যের লেখা গান, ‘প্রথম আলোক, লহ প্রণিপাত’। বরেণ্য শিল্পী শাহীন সামাদের কণ্ঠে শোনা যাবে কাজী নজরুল ইসলামের ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে’ গানটি।
গত রোববারে মহড়ায় বসে শিল্পী শাহীন সামাদ বললেন, প্রতিবছরই বাংলা নববর্ষ বরণ করতে ছায়ানট নিয়ে আসে নতুন গান। আগের বছরে গাওয়া গানগুলো পরের বছর পরিবেশন করা হয় না। শাহীন সামাদের কথাটি আরেকটু সহজ করে বললেন পার্থ তানভির নভেদ। বললেন, ছায়ানট খেয়াল রাখে যাতে আগের পাঁচ–ছয় বছরে গাওয়া কোনো গানের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
আগামী পয়লা বৈশাখের প্রভাতে রমনার বটমূলে ছায়ানটের থাকবে ৩০টি পরিবেশনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আঁধার রজনী পোহালো’ অথবা ‘তোমার সুর শুনায়ে’র মতো জনপ্রিয় গানের সঙ্গে তাঁরা রেখেছেন অতুলপ্রসাদের ‘ওরে বন, তোর বিজনে সঙ্গোপনে’র মতো দাদরা তালের গান। এসবই একক সংগীত। কাজী নজরুল ইসলামের ‘নম নম নম বাংলাদেশ মম’ আর ‘আনো আনো অমৃত বারি’র পাশাপাশি থাকবে নিশিকান্ত রায় চৌধুরীর ‘অধরা দিল ধরা এ ধুলার ধরণিতে’।
শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের উৎসাহেরও যেন শেষ নেই। ছায়ানটের ধানমন্ডি কার্যালয়ের মিলনায়তনে যখন মহড়া চলছে, বাইরে তখন অপেক্ষা করছেন তাঁরা। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা এসেছেন রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকে, কিন্তু ঘড়ির কাঁটা ধরে ১০টার আগে আগে। তাঁরা বললেন, শুধু তো গান নয়, ছায়ানট শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতার মূল্যও কম শেখাচ্ছে না।
বর্ষবরণের আয়োজনের সবশেষে পরিবেশিত হবে জাতীয় সংগীত। তার আগে থাকবে বাংলাদেশের বরেণ্য রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী এবং ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সন্জীদা খাতুনের নতুন বছরের আশীর্বাণী। তিনি অনুপস্থিত থাকলে তাঁর পক্ষে কেউ সেটা পড়ে শোনাবেন।
ছায়ানট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬১ সালে। ষাটের দশকের পাকিস্তানি শাসনামলের গনগনে রাজনৈতিক আবহাওয়ায় ১৯৬৭ সালে শুরু হয়েছিল তাদের নববর্ষ বরণ অনুষ্ঠান। এর পর থেকে প্রতিবছর রমনার বটমূলে গানে গানে নতুন বাংলা বছরকে আবাহন করে আসছে ছায়ানট। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু এর ব্যত্যয় ঘটেছিল। ২০০১ সালের নববর্ষ বরণ অনুষ্ঠানে জঙ্গিরা বোমা হামলা করেছিল। তাতে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তবু কোনো বছরই অনুষ্ঠানে ছেদ পড়েনি। করোনা অতিমারির দুটি বছরও ছায়ানট নববর্ষকে বরণ করেছে অনলাইনে। এবারের ঈদের দীর্ঘ ছুটিতেও তাই বর্ষবরণ বাদ পড়বে না।