পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় প্রচারণা নেই, অনেকই জানেন না ভোট কবে
রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির দুর্গম এলাকার অনেক গ্রামে নেই নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা। এসব এলাকার ভোটকেন্দ্র গ্রাম থেকে অনেক দূরে। কিছু এলাকায় ভোটারদের ভোট বর্জন করার আহ্বান জানিয়েছে আঞ্চলিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এসব কারণে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির দুর্গম এলাকার ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসা চ্যালেঞ্জের হতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়িসহ ১০টি উপজেলার বেশ কিছু এলাকা দুর্গম। দুই থেকে ছয় ঘণ্টা পায়ে হেঁটে ভোটকেন্দ্রে যেতে হয় এসব এলাকার ভোটারদের। কিছু এলাকায় আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা সময় লাগে বিভিন্ন যানবাহনে করে যেতে। এসব এলাকার ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিতে সাধারণত এক থেকে দেড় মাস আগে কাজ শুরু করেন মৌজা ও গ্রামপ্রধানেরা। তবে এবার নির্বাচনে প্রার্থীদের পক্ষে এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
রাঙামাটি আসনে তিন প্রার্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দীপংকর তালুকদারের পক্ষে দুর্গম এলাকায় কিছুটা প্রচারণা চললেও অন্য দুই প্রার্থীর পক্ষে কোনো প্রচারণা হয়নি।
রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, রাঙামাটি আসনের দুর্গম এলাকায় সড়ক যোগাযোগ না থাকায় হেলিকপ্টারে করে নির্বাচনী সরঞ্জাম ও ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের পাঠানো হবে। দুর্গম চারটি উপজেলার জন্য ১৮টি হেলিকপ্টার রয়েছে। এর মধ্যে বাঘাইছড়ির জন্য ছয়টি, বরকলের জন্য দুটি, জুরাছড়ির জন্য সাতটি ও বিলাইছড়ি উপজেলার জন্য তিনটি। এসব এলাকায় অনেক গ্রামের সঙ্গে ভোটকেন্দ্রের দূরত্ব এক থেকে ছয় ঘণ্টার। ভোট দিতে অনেক ভোটারকে এক দিন আগে ভোটকেন্দ্রের আশপাশে অবস্থান করতে হয়।
রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়িসহ ১০টি উপজেলার বেশ কিছু এলাকা দুর্গম। দুই থেকে ছয় ঘণ্টা পায়ে হেঁটে ভোটকেন্দ্রে যেতে হয় এসব এলাকার ভোটারদের। কিছু এলাকায় আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা সময় লাগে বিভিন্ন যানবাহনে করে যেতে। এসব এলাকার ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিতে সাধারণত এক থেকে দেড় মাস আগে কাজ শুরু করেন মৌজা ও গ্রামপ্রধানেরা। তবে এবার নির্বাচনে প্রার্থীদের পক্ষে এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ও বঙ্গলতলী ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকায় ইউপিডিএফের নিয়ন্ত্রণ প্রবল। অন্যদিকে সদর, কাউখালী, নানিয়ারচর ও লংগদু উপজেলার বেশ কিছু এলাকায়ও ইউপিডিএফের আধিপত্য রয়েছে। ইউপিডিএফ নির্বাচন বর্জন ঘোষণা করায় এসব এলাকার ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
গত ২৬ ডিসেম্বর ইউপিডিএফের ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দলটির প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগের প্রধান নিরন চাকমা স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি জুরাছড়ি উপজেলায় জেলা পরিষদের সদস্য প্রবর্তক চাকমার নেতৃত্বে শিলছড়ি, বড়হলক, ঘিলালুদি মোন হয়ে বগাখালী পর্যন্ত প্রচারণা করা হয়। কিন্তু প্রত্যন্ত ও দুর্গম ৮০ ভাগ এলাকায় এখনো প্রচারণা করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া বরকল, বিলাইছড়ি ও বাঘাইছড়ির সাজেক ইউনিয়নের প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকায় এখনো প্রচারণা চালানো হয়নি। নানিয়ারচর, লংগদুসহ অন্য উপজেলার দুর্গম এলাকায়ও প্রচারণা কম। প্রচারণা যা চলছে, তা মূলত আওয়ামী লীগের প্রার্থী দীপংকর তালুকদারের।
নির্বাচনী প্রচারণা বেশি চলছে উপজেলা সদরে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে দলীয় নেতা-কর্মীরা প্রচারণা চালাচ্ছেন। অন্য প্রার্থীদের মধ্যে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক মুক্তি জোটের প্রার্থী অমর কুমার দে নিজের প্রচারণা করছেন নিজেই। তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী শাহ হাফেজ মো. মিজানুর রহমানের প্রচারণা নেই বললেই চলে।
খাগড়াছড়িতে দুর্গম পাহাড়ি এলাকাগুলোতেও নেই নির্বাচনের আমেজ। সেখানে দেখা যায়নি কোনো প্রার্থীর পোস্টার। এখানকার অনেক বাসিন্দাই জানেন না, ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
নৌকার বাইরে অন্য দুই প্রার্থী দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকা দূরে থাক, সব উপজেলা সদরেই প্রচারণা শেষ করতে পারেননি।
বাঘাইছড়ির সাজেক ইউনিয়নের বড় কংলাক গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য মোহন লাল চাকমা বলেন, ‘আমাদের গ্রাম ও আশপাশের এলাকার মানুষকে এক থেকে দেড় ঘণ্টা পায়ে হেঁটে ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়। আমাদের এলাকায় এখনো কোনো প্রার্থী প্রচারণা চালাননি। আমরা কাকে ভোট দেব, নাকি দেব না, এ বিষয়ে আলোচনা হয়নি। যেহেতু কোনো প্রার্থী কিংবা প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চলেনি, এ কারণে হয়তো অনেক ভোটার ভোট দিতে যাবেন না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাজেকের কয়েকজন ভোটার বলেন, ‘আমাদের ভোট দিতে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। একদিকে একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ভোটদানে নিরুৎসাহিত করছে, অন্যদিকে প্রচারে কোনো প্রার্থী আসেননি। তা ছাড়া ভোটকেন্দ্রে যেতে এক থেকে ছয় ঘণ্টা হাঁটতে হয়।’
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক মুক্তি জোটের প্রার্থী অমর কুমার দে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ১০ উপজেলার মধ্যে ৮ উপজেলায় জনসংযোগ ও ভোটারদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেছি। এখনো নানিয়ারচর ও বরকল উপজেলায় যেতে পারিনি। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে দুই উপজেলায় ভোটারদের কাছে ভোট চাইতে যাব। সময়ের অভাবে দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায় যাওয়া সম্ভব হয়নি। সে জন্য সবার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।’
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা বলেন, দুর্গম এলাকায় ইউপিডিএফের আধিপত্য থাকায় ভয়ে কেউ প্রচারণায় যেতে পারেননি। অন্য দুর্গম এলাকায় প্রচারণার জন্য কিছু লোকজন পাঠানো হয়েছে। আজ না হয় কাল পৌঁছে ভোটারদের সঙ্গে যা যা করা প্রয়োজন, তা করার চেষ্টা করা হবে।
আমাদের গ্রাম ও আশপাশের এলাকার মানুষকে এক থেকে দেড় ঘণ্টা পায়ে হেঁটে ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়। আমাদের এলাকায় এখনো কোনো প্রার্থী প্রচারণা চালাননি। আমরা কাকে ভোট দেব, নাকি দেব না, এ বিষয়ে আলোচনা হয়নি। যেহেতু কোনো প্রার্থী কিংবা প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চলেনি, এ কারণে হয়তো অনেক ভোটার ভোট দিতে যাবেন না।
খাগড়াছড়ির দুর্গম এলাকার অনেক বাসিন্দা জানেন না ভোট কখন
খাগড়াছড়িতে দুর্গম পাহাড়ি এলাকাগুলোতেও নেই নির্বাচনের আমেজ। সেখানে দেখা যায়নি কোনো প্রার্থীর পোস্টার। এখানকার অনেক বাসিন্দাই জানেন না, ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
খাগড়াছড়ি আসনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, সোনালী আঁশ প্রতীকে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী উশেপ্রু মারমা, লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মিথিলা রোয়াজা ও আম প্রতীকে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির প্রার্থী মো. মোস্তফা।
প্রার্থীদের মধ্যে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ছাড়া অন্য তিন প্রার্থীকে সদর উপজেলার বাইরে বাকি আটটি উপজেলায় প্রচারণা চালাতে দেখা যায়নি। এ তিন প্রার্থী এখন পর্যন্ত করেননি পথসভা ও মাইকিং। এমনকি তাঁদের পোস্টারও দেখা যায়নি।
পানছড়ি উপজেলার কাশিপাড়া, রোহিন্দ্রপাড়া, মরাটিলা, লতিবান, লোগাং, পুজগাং, দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের বিষ্ণু কার্বারিপাড়া, লম্বাছড়া, রেংহাজ্জ্যে, বাবুছড়া ইউনিয়নের নারাইছড়া, জামতলী, মহালছড়ি উপজেলার মুবাছড়ি, লক্ষ্মীছড়ি উপজেলায় শুকনোছড়ি, টুল্যাপাড়া, জুরমনিপাড়া, বিজি কিজিংসহ জেলার সব উপজেলার দুর্গম এলাকায় নির্বাচনের প্রচারণা নেই।
পানছড়ি বাজার থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে কাশিপাড়া ও রোহিন্দ্রপাড়া। দুই পাড়ায় সব মিলিয়ে ছোট ছোট সাত থেকে আটটি পাহাড়ে বসবাস করেন ৭৩টি পরিবার। গতকাল মঙ্গলবার এই দুই পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, কোথাও টাঙানো হয়নি কোনো পোস্টার। পাড়ার বেশির ভাগ নারী জানেন না নির্বাচনের কথা।
কাশিপাড়ার বাসিন্দা গৃহিণী শেফালি ত্রিপুরা, কমলিকা ত্রিপুরা ও পদ্মা দেবী ত্রিপুরা বলেন, তাঁদের পাড়ায় কেউ ভোট চাইতে এখন পর্যন্ত আসেননি। কতজন প্রার্থী, তাঁদের প্রতীক কী, তাঁরা কিছুই জানেন না। নির্বাচন কবে হবে, তা-ও জানা নেই। যেহেতু কেউ ভোট চাইতে আসেননি, তাই তাঁরা ভোট দিতেও যাবেন না।
তবে রোহিন্দ্রপাড়ার দেবপ্রিয় ত্রিপুরা গত সপ্তাহে পানছড়িতে এসে নির্বাচনের খবর জেনেছেন। বাজার এলাকায় দেখেছেন কিছু পোস্টার। লোকজনের মুখে শুনেছেন ৭ জানুয়ারি নির্বাচন হবে। তবে তিনি ভোট দিতে যাবেন না। তিনি বলেন, নির্বাচনে কেউ তাঁদের কাছে ভোট চাননি। তাঁদের কোনো গুরুত্ব নেই কারও কাছে। শুধু শুধু চার কিলোমিটার হেঁটে ভোট দিতে যাবেন না।
লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার জুরমনিপাড়ার বাসিন্দা উদয়ন চাকমা। তিনি ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের খবর জেনেছেন প্রতিবেশীর বাড়িতে টেলিভিশন দেখতে গিয়ে। ভোট দিতে যাবেন কি না প্রশ্ন করা হলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে জানতে চান, ভোট দিয়ে কী লাভ?
দুর্গম এলাকার তরুণেরা নির্বাচন সম্পর্কে জানলেও ভোটের ব্যাপারে তাঁদেরও কোনো আগ্রহ নেই। তবে তাঁরা চান ক্ষমতায় যে–ই আসুক, পাহাড় যেন হানাহানি ও দুর্নীতিমুক্ত হয়।
দীঘিনালার দুর্জয় চাকমা ও মানিকছড়ির চাইলাউ মারমা নতুন ভোটার হয়েছেন। জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, এবারই তাঁদের প্রথম ভোট। তবে তাঁরা এখন পর্যন্ত ভোট দিতে যাবেন কি না, সিদ্ধান্ত নেননি।
তাঁদের মতে, নৌকার বিপক্ষে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, তাই ভোট দেওয়া না-দেওয়া সমান।
দুর্গম এলাকায় কেন প্রচারণা নেই, জানতে চাইলে নৌকা প্রার্থীর প্রধান এজেন্ট চাইথোঅং মারমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলার প্রতিটি ইউনিয়নে এবং জনবহুল গ্রামে নৌকার প্রার্থীর পথসভা হচ্ছে। প্রার্থী নিজে গিয়ে এসব এলাকায় ভোট চাইছেন। এ ছাড়া আমাদের দলীয় লোকজন প্রতিটি গ্রামে গিয়ে লিফলেট বিলি করছেন, উঠান বৈঠক করছেন। যেহেতু এখনো সময় আছে, দলীয় লোকজন ক্রমান্বয়ে সব এলাকায় ভোট চাইতে যাবেন।’
খাগড়াছড়িতে মোট ভোটার সংখ্যা ৫ লাখ ১৫ হাজার ৪১৭। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৬২ হাজার ৪৪, নারী ভোটার ২ লাখ ৫৩ হাজার ৩৭১ ও হিজড়া ২ জন।