সুইডেনে ইলেকট্রনিক বোর্ডে স্থান পেল আদৃতার ছবি
সুইডেনের ‘গোথেনবার্গ প্রপোজাল’(গোথেনবার্গ প্রস্তাব)-এ গোথেনবার্গের উন্নয়নে মানুষের প্রত্যাশা জানতে চাওয়া হয়েছিল। সরকারিভাবে এ আহ্বান জানিয়ে শহরের বিভিন্ন জায়গায় বসানো হয়েছিল ইলেকট্রনিক বোর্ড। তাতে জায়গা করে নিয়েছিলেন আদৃতা আহমেদ।
গোথেনবার্গ শহরে জন্ম নেওয়া ১৯ বছরের আদৃতা সুইডেনের ৫০টি শহরের যুবদের ‘কালচারাল অ্যাম্বাসেডর’ ও গোথেনবার্গ সরকারের ‘কালচারাল অ্যাডভাইজার’ হিসেবে কাজ করছেন।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত গোথেনবার্গের বিভিন্ন জায়গায় ইলেকট্রনিক বোর্ডে ভায়োলিন হাতে আদৃতার হাসিমুখের ছবিটি অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শহরটিতে বসবাসরত আদৃতার পরিবার ছাড়াও সেখানকার বাঙালি কমিউনিটির সদস্যরা বিষয়টিকে নিয়েছিলেন উচ্ছ্বাসের সঙ্গে।
ইলেকট্রনিক বোর্ডটিতে স্থানীয় ভাষায় যা লেখা ছিল, সেটির অনুবাদ করে প্রথম আলোকে অর্থ বলে দিলেন আদৃতার মা ফারজানা আহমেদ। এর সারমর্ম হচ্ছে—‘গ্রুপ মিউজিক এক্সপার্ট আদৃতা বলেছেন, “আমি চাই, আমার মতো আরও অনেকেই মিউজিক শিখবে।” এরপর গোথেনবার্গ সরকারের পক্ষ থেকে কিছু প্রশ্ন ও বার্তা রয়েছে। যেমন “তুমি কিসে এক্সপার্ট? গোথেনবার্গ নিয়ে তোমার প্রপোজাল এখানে জমা করো। গোথেনবার্গ প্রপোজাল কী? গোথেনবার্গ প্রস্তাবনা তাঁদের জন্য, যাঁদের নতুন আইডিয়া আছে।”’
কীভাবে গোথেনবার্গের আরও উন্নয়ন করা যায়, সেই প্রস্তাব ওয়েবসাইটে দিতে বলা হয়। অন্যদের প্রস্তাবেও ভোট দেওয়া যাবে এবং যে প্রস্তাব ২০০ ভোট পাবে, তা নীতিনির্ধারকদের কাছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য পাঠানো হবে, এমন তথ্যও ছিল এই বোর্ডে। বোর্ডে ছিল একটি কিউআর কোড; যার মাধ্যমে এসব জানার ব্যবস্থা করা হয়।
সুইডেনের দ্বিতীয় বড় শহর গোথেনবার্গ। হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয় আদৃতা ও তাঁর মা ফারজানা আহমেদের সঙ্গে। ফারজানা বলেন, ‘গোথেনবার্গে সাধারণত সুইডিশ শিশুরা প্রাধান্য পায়। সেখানে বাঙালি পরিবারের কালো চুলের আদৃতা আমাদের গর্বিত করল। ঘুরে ঘুরে আমি আর আদৃতার বাবা ৮ থেকে ১০টি বোর্ডে মেয়ের ছবি দেখেছি। আদৃতার বাবার জন্মদিন ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি, তাঁকে বলেছি, “এটি তোমার জন্মদিনের উপহার।”’
আদৃতা বর্তমানে থিয়েটার নিয়ে পড়াশোনা করছেন। অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করার জন্য আলাদা কোর্সও করছেন। নিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতিও।
সুইডিশ, ইংলিশ, স্প্যানিশ ভাষায় দক্ষতা অর্জন করার পাশাপাশি আদৃতা বাড়িতে বাবা, মা ও বোনদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলেন। আদৃতার বোন নিয়ন্তা আহমেদ চেলো (ভায়োলিন) ও বেজ গিটার এবং আরেক বোন লামিয়া নুরও চেলো বাজান। লামিয়াও থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত।
সাত বছর বয়সে আদৃতা অর্কেস্ট্রা মিউজিক স্কুলে ভায়োলিন বাজানো শেখা শুরু করেন। ১৯ বছর বয়সেই তাঁর গোথেনবার্গসহ সুইডেনের বিভিন্ন শহরে অর্কেস্ট্রা কনসার্টে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। কাজ করেছেন গোথেনবার্গ অপেরা, গোথেনবার্গ সিম্ফোনিকা অর্কেস্ট্রাসহ বিখ্যাত সব মঞ্চে।
আদৃতা অংশ নিয়েছেন সুইডেনের রাজার উপস্থিতিতে গোথেনবার্গের ৪০০ বছর পূর্তি উৎসবের কনসার্টে। ইউমে মিউজিক ফেস্টিভ্যাল, পৃথিবীর ৩০টি দেশ থেকে প্রায় ৩ হাজার মিউজিশিয়ানের অংশ নেওয়া ৫ দিনের মিউজিক ক্যাম্প ‘সাইড বাই সাইড’-এও অংশ নিয়েছেন তিনি।
আদৃতার বাবা আজহার আহমেদ ভলবোর মূল দপ্তরে কনটিনেন্টাল ম্যাটেরিয়াল প্ল্যানার হিসেবে কর্মরত। কলেজে পড়ার সময়ই তিনি বাংলাদেশ থেকে সুইডেন যান। নরওয়ের অসলো ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে চারুকলায় পড়াশোনা শেষ করেন। দেশে থাকা অবস্থায়ই ছবি আঁকায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পান তিনি।
আদৃতার মা ফারজানা আহমেদ চট্টগ্রামে চারুকলায় পড়াশোনা করেছেন। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তি মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। থিয়েটার, অভিনয়, অনুষ্ঠান উপস্থাপনা—নানান বিষয়ের সঙ্গে ছিলেন যুক্ত। এখন গোথেনবার্গ সরকারের অধীন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে এবং সরকারি কালচারাল সেন্টারে সপ্তাহে এক দিন চারুকলার শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নিজেদের ব্যবসা পরিচালনায়ও সহায়তা করছেন তিনি। মাস্টার্স পড়ার সময় তিনিও সুইডেনে এসে থিতু হন।
ফারজানা আহমেদ জানান, আদৃতাকে তাঁরা ‘লিটল স্টার’ বলে ডাকেন। তিনি বললেন, মেয়ে ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিচিত মুখ। আদৃতাসহ তিনজন মিলে একটি বই বের করার কাজ করছে। ছোট থেকেই সে গান লেখে, গানে সুর দেয়, গান গায়। ভায়োলিনের পাশাপাশি গিটার বাজায়। গোথেনবার্গের বিভিন্ন পত্রিকায় আদৃতার ছবি ছাপা হয়েছে।
ফারজানা আহমেদ বলেন, ‘সুইডিশ রাজার মেয়ে ভিক্টোরিয়ার সামনে দুবার ভায়োলিন বাজিয়ে গান গেয়েছে সাত বছরের আদৃতা। রাজকুমারী ভিক্টোরিয়া পরে আদৃতাকে জড়িয়ে ধরে আদর করেছেন। পরের দিন সকালে পত্রিকাগুলোয় দেখলাম, প্রথম পাতার প্রধান নিউজে ভায়োলিন হাতে আদৃতা আর পেছনে দাঁড়ানো সুইডেনের রাজকন্যা ভিক্টোরিয়ার ছবি।’
আদৃতা সিনেমায় অভিনয় করেছেন; যা গোথেনবার্গ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো হয়েছে বলে জানালেন তাঁর মা। তিনি আরও বলেন, আদৃতা স্টকহোমে সুইডিশ টেলিভিশনে শিশুদের অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকার দিয়েছে এবং সুইডিশ পার্লামেন্টে গিয়ে মন্ত্রীসহ অন্যদের বিভিন্ন প্রশ্ন করেছে। সুইডেনের আন্তর্জাতিক গায়িকা এভা ডলগ্রেনের সঙ্গেও মোবাইল ফোন থ্রির বিজ্ঞাপনে অংশ নেওয়া, আন্তর্জাতিক হিপহপ গায়ক টিম্বাকটুর সঙ্গে একই মঞ্চে কাজ করা, ফটো এডিটিং কোর্স করাসহ সে সব সময়ই কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
অন্যদিকে ইলেকট্রনিক বোর্ডে নিজের ছবি দেখার অনুভূতি জানতে চাইলে আদৃতা বলেন, ‘শহরের চারপাশে বোর্ডে নিজেকে দেখে অনেক ভালো লেগেছে। আমার পরিবারের সদস্য ও বন্ধুরা আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। অবশ্যই এটি ছিল অনেক আনন্দের।’