শীতের আমেজ নেই, গরমও শুরু হয়েছে বেশ। লালন আখড়াবাড়িতে লোকজনের জটলায় গরম অনুভূত হচ্ছে আরও বেশি। তবে রৌদ্র আর গরমের দিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই খুব একটা।
মানুষের হরদম আসা-যাওয়া। লালন অনুসারীদের পোশাক সাধারণত সাদা। সাদা পোশাকধারীদের বাইরেও নানা প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা যোগ দিয়েছেন লালন স্মরণোৎসবে। গান, আলোচনা আর ভাব-ভালোবাসা বিনিময় করে সময় কাটছে তাঁদের।
তিন দিনের লালন স্মরণোৎসব ঘিরে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়ায় লালন আখড়াবাড়ি এখন সরগরম। গতকাল শনিবার সকালেই শুরু হওয়া এ উৎসব চলবে আগামীকাল সোমবার মধ্যরাত পর্যন্ত। বাউলদের মূলত অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেওয়া লাগে না। পূর্ণিমার তিথি ধরে তাঁরা চলে আসেন।
লালন–ভক্ত ফকির মামুন বলেন, লালন ফকির জীবিত থাকতে প্রতি পূর্ণিমায় গানের আসর বসাতেন। সেখানে তাঁর শিষ্যরা আসতেন। বাউলদের অভ্যন্তরীণ কিছু বিষয় নিয়ে গুরু-শিষ্যের ভাব বিনিময় হতো। এখন সেটা উৎসবে পরিণত হয়েছে।
১৮৯০ সালের ১ কার্তিক লালন সাঁই কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ছেঁউড়িয়া গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। এর পর থেকে আখড়াবাড়ি চত্বরে তাঁর ভক্ত-অনুসারীরা তাঁদের সাঁইজিকে স্মরণ করে আসছেন। পরে লালন একাডেমি এ আয়োজনের দায়িত্ব নেয়। অপর দিকে ফকির লালন শাহ দোলপূর্ণিমা তিথিতে সাধুদের নিয়ে এক দিনের সাধুসঙ্গ করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় লালন একাডেমি প্রতিবছর এ আয়োজন করছে। গতকাল মূলত এ আয়োজনই শুরু হয়েছে।
লালনের আখড়াবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, হাজারো ভক্ত-অনুসারী দূরদূরান্ত থেকে ছেঁউড়িয়ায় আখড়াবাড়িতে জড়ো হয়েছেন। অনেক বাউল তাঁর সঙ্গিনীকে নিয়ে এসেছেন। মিলনায়তনের নিচে বসার জায়গায় এখন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ভেতরের মূল আঙিনা ছাড়িয়েও সামনের কালী নদীর পাড় ঘেঁষে মাঠে অনেকে জায়গা করে নিয়েছেন। তবে লালনের যাঁরা মূল ভক্ত, তাঁরা আখড়ার ভেতরে তাঁর মাজারের আশপাশে বসেন।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সমাগম বাড়তে থাকে। কথা হয় বাউল, সাধু আর দর্শনার্থীদের সঙ্গে। মেহেরপুর থেকে আসা সিয়াম মাহমুদ জানান, তাঁরা ১৪ বন্ধু ঘুরতে এসেছেন উৎসবে। এক দিন থেকে তারপর বাড়ি ফিরবেন। গান শুনেছেন। ফকিরদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। নিজেদের চিন্তায় পরিবর্তন এসেছে।
বাউল নিজাম উদ্দীন বলেন, পূর্ণিমায় মূলত বাউলেরা মূল যে কাজ, সেটা সেরে ফেলেন। এরপর তাঁরা আর থাকেন না। কেউ কেউ থাকেন।
শাহ সুফি এনাম শাহ তাঁর শিষ্যদের নিয়ে দরাজ গলায় গান করছিলেন মিলনায়তনের নিচে বসে। তাঁর গান শুনে ভিড় করেন অনেকে। তিনি এসেছেন ঢাকা থেকে। বেশভূষায় একটু আলাদা। কথাও বলেন ভাব মনে। এনাম শাহ বলছিলেন, ‘ভালোবাসা না থাকলে ভাব হয় না। মানুষের মধ্যে এখন আমিত্বটা বড় হয়ে উঠেছে। তাই কেউ কাউকে সহজে মানতে পারে না। মানুষে মানুষে হিংসা, বিদ্বেষ আর মারামারি লেগে যায়।’
এবার বাউলদের জন্য নতুন শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে। সঙ্গে সুপেয় পানির ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন আর লালন একাডেমি পুরো অনুষ্ঠানের সমন্বয় করছে। অনুষ্ঠানের খরচের জন্য মেলার মাঠ ইজারা দেওয়া হয়েছে ২৬ লাখ টাকায়।
লালন একাডেমি সূত্র জানায়, বাউলদের জন্য মোট তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। বাকি খাবার তাঁরা তাঁদের মতো করে ব্যবস্থা করেন। খাবারের নামেও বৈচিত্র্য আছে, সকালে বাল্যসেবা আর দুপুরে পূর্ণসেবা। দুপুরের খাবারে সাদা ভাত, মাছ, সবজি, ডাল আর দই দেওয়া হয়।
বাউলেরা তাঁদের মতো আচার করলেও সরকারি আয়োজনও থাকে। সেখানে মাঠে আলোচনা সভা ও গানের আসর বসে। মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ছাড়া সরকারি কর্মকর্তারাও অতিথি হয়ে আসেন। একাডেমির তালিকাভুক্ত শিল্পীরা ছাড়া সারা দেশ থেকে প্রথিতযশা শিল্পীরাও আসেন গান করতে।
গতকাল জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামের সভাপতিত্বে উৎসবের উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফ। উৎসবের এবারের প্রতিপাদ্য, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’।
লালন একাডেমির আয়োজনে ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এবং কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে গতকাল শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী এ উৎসবে থাকছে লালন মেলা, লালনের জীবনদর্শন নিয়ে আলোচনা সভা ও সংগীতানুষ্ঠান।
লালন মেলা উপলক্ষে আখড়াবাড়ি প্রাঙ্গণ ও এর আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো ছাড়াও পুলিশ, র্যাব ও সাদাপোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন আছেন, জানালেন কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার খাইরুল আলম।