জামুকার সিদ্ধান্ত
অবশেষে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাচ্ছেন ‘যুদ্ধশিশুরা’
বীরাঙ্গনার সন্তানকে ‘যুদ্ধশিশু’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে নির্যাতিত বীরাঙ্গনার সন্তানদের ‘যুদ্ধশিশু’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এ ছাড়া তাঁদের চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে পিতার নাম লেখার প্রয়োজন হবে না। পিতার নাম ছাড়াই তাঁরা রাষ্ট্রের সব সুবিধা বা অধিকার ভোগ করতে পারবেন।
গতকাল সোমবার জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৮২তম বৈঠকে একজন বীরাঙ্গনার সন্তানের যুদ্ধশিশু হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ–সংক্রান্ত প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে পাঠানো হবে। মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
আমরা নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যাঁরা যুদ্ধশিশু, তাঁদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে। পিতার নাম ছাড়াই তাঁরা যেন রাষ্ট্রীয় সব সুবিধা বা অধিকার ভোগ করতে পারেন, সে জন্যই এ সিদ্ধান্ত।আ ক ম মোজাম্মেল হক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী
জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খাজা মিয়া প্রথম আলোকে জানান, ‘এত দিন যুদ্ধশিশু হিসেবে বাংলাদেশে কোনো শিশু স্বীকৃতি পেতেন না। আমাদের কাছে একজন বীরাঙ্গনার সন্তান আবেদন করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, কোথাও কোনো আবেদনে পিতার নাম উল্লেখ করতে পারছেন না তিনি। কারণ, তাঁর মা বীরাঙ্গনা। বাবার নাম না লিখতে পারায় কোনো চাকরিও পাচ্ছেন না। তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জামুকার বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়।’
জামুকা সূত্র জানায়, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত পচি বেগমের সন্তান মেরিনা খাতুন জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে গত ৮ সেপ্টেম্বর যুদ্ধশিশু হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চেয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদনটি পাঠান।
আবেদনে মেরিনা খাতুন উল্লেখ করেন, ‘আমার মাতা মৃত পচি বেগমকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রীয়ভাবে ২০১৮ সালের ৪ জুলাই বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। যার গেজেট নম্বর ২০৫। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমার মাতা পচি বেগম পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। সে সময় আমি তাঁর গর্ভে জন্মগ্রহণ করি। উল্লেখ্য, সে সময় আমার মাতা বিধবা ছিলেন।
লোকলজ্জার ভয়ে তিনি আমাকে ভ্রূণেই শেষ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যগুণে আমি বেঁচে যাই এবং মায়ের অন্য সন্তানদের দয়া ও ভালোবাসায় আমি বেড়ে উঠি। সম্প্রতি আমার মা পচি বেগম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেও আমার কোনো পরিচয় আজও আমি নিশ্চিত করতে পারিনি।’
১০ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ওই আবেদনটি জামুকার বৈঠকে উত্থাপনের নির্দেশ দেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই–বাছাই ও তালিকা প্রণয়নের কাজটি জামুকার মাধ্যমে হয়।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যাঁরা যুদ্ধশিশু, তাঁদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে। পিতার নাম ছাড়াই তাঁরা যেন রাষ্ট্রীয় সব সুবিধা বা অধিকার ভোগ করতে পারেন, সে জন্যই এ সিদ্ধান্ত।’
যুদ্ধশিশু বলতে কাদের বোঝানো হবে, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, বীরাঙ্গনার সন্তানেরাই যুদ্ধশিশু হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাবেন।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে (এমআইএস) গেজেটভুক্ত বীরাঙ্গনার সংখ্যা হালনাগাদ নয়। সরকারি তালিকায় এখন পর্যন্ত বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৪৪৮ জন থাকলেও এমআইএসে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ৪০২ জনের নাম। এর মধ্যে ৮৯ জন বীরাঙ্গনারই নামে রয়েছে বানানসহ বিভিন্ন ধরনের ভুল।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পর যুদ্ধশিশু হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের বিষয়ে মেরিনা খাতুন (আবেদনকারী) গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যুদ্ধশিশু হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাই।
আমার যে অধিকার, তা যেন রাষ্ট্র আমাকে দেয়। আমার মতো যাঁরা আছেন, তাঁদের সন্তানেরা যেন তাঁদের মাকে নিয়ে বিব্রত না হন, সেই বিষয়টি বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রকে অনুরোধ জানাচ্ছি।’