সাক্ষাৎকার: সারজিস আলম

যৌক্তিক আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কথা বললে তা হতাশ করে

সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়ে আপিল বিভাগ গত বুধবার স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দিয়ে শুনানির জন্য আগামী ৭ আগস্ট দিন রেখেছেন। এই আদেশের ফলে কোটা আপাতত কার্যকর থাকছে না বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। তবে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। এ বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন আন্দোলনকারীদের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। তিনি ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেলে নির্বাচিত হল সংসদের সদস্য ছিলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মোহাম্মদ মোস্তফা

প্রথম আলো:

আপিল বিভাগের সর্বশেষ আদেশের ফলে আপাতত কোটা থাকছে না বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল। এ অবস্থায় আপনাদের আন্দোলন করার যৌক্তিকতা কোথায়?

সারজিস আলম: আমাদের এক দফা দাবি হলো সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার। ২০১৮ সালের পরিপত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে (নবম থেকে ১৩তম গ্রেড) সব কোটা বাতিলের কথা বলা হয়েছে। প্রথমত, আমরা চাইছি, সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার হোক। দ্বিতীয়ত, ২০১৮ সালের পরিপত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কোটা বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু আমরা বলছি কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের কথা। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে কিছু অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের আসলে এই কোটার সুবিধা যৌক্তিক মাত্রায় দেওয়া প্রয়োজন। তৃতীয়ত, ২০১৮ সালের পরিপত্রে ত্রুটি ছিল, গত ৫ জুন মহামান্য হাইকোর্ট এই পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেন। তাহলে যে পরিপত্র ইতিমধ্যেই ত্রুটিপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছে, সেই পরিপত্র আবার বহাল করা কিংবা বাতিল করা কিংবা তার ওপর আস্থা রাখা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা মনে করি, ২০১৮ সালের পরিপত্রটি যদি আবার বহালও হয়, তা ছাত্রসমাজের এক দফা দাবিকে প্রতিফলিত করে না। তাই আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি।

মহামান্য হাইকোর্টে কোটার নির্দিষ্ট একটি অংশ বিচারাধীন। তার মানে কোটার অন্যান্য অংশ নিয়ে আমরা কথা বলতে পারব না, দাবি জানাতে পারব না বা আন্দোলন করতে পারব না, বিষয়টি এমন নয়।

প্রথম আলো:

আন্দোলনের প্রাথমিক অবস্থায় আপনারা প্রথম শ্রেণিসহ সুনির্দিষ্ট কয়েকটি গ্রেডে সংস্কারের কথা বলেছিলেন। এখন চাকরির সব ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলছেন। বিষয়টি পরিষ্কার করবেন?

সারজিস আলম: আমরা যখন প্রথমে চারটি দাবির কথা বলেছিলাম, তখন প্রথম দাবি ছিল, ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখতে হবে এবং দ্বিতীয় দাবি ছিল, পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দিয়ে সংবিধান অনুযায়ী শুধু অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করতে হবে। তার মানে আমরা তখনো সব গ্রেডের কথাই বলেছিলাম।

প্রথম আলো:

সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের লোকজন বলেছেন, সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি এখন আদালতের বিষয়। তাই আদালতেই এর সমাধান হোক। তবে প্রয়োজনে আলোচনার কথাও বলেছেন। এ বিষয়ে আপনাদের কী বক্তব্য?

সারজিস আলম: আমরা বিশ্বাস করি, কোটাব্যবস্থার যৌক্তির সমাধান সরকারের একটা নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। অর্থাৎ এ বিষয়ে সরকার যদি আলোচনা করে, সরকার যদি গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের নিয়ে বসে যৌক্তিক সংস্কার আনে এবং আইনসভা থেকে আইন প্রণয়ন করে, তাহলেই তো এই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আমাদের তো তাহলে আর রাজপথে যেতে হয় না। আমরা আমাদের পড়ার টেবিলে ফিরে যেতে পারি। বুধবার মহামান্য হাইকোর্টের (হাইকোর্টের রায়ের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনাসংবলিত অংশে) রায়ে সব কোটা বজায় রাখতে বলা হয়েছে। তবে প্রয়োজনে সরকার তা কমাতে বা বাড়াতে পারবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই বিষয়টি এখন সরাসরি সরকারের হাতে। কিন্তু দায়িত্বশীল জায়গা থেকে যদি কোনো মন্ত্রী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কিংবা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের যৌক্তিক আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এমন কোনো কথা বলেন, যেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই, সেগুলো আমাদের হতাশ করে। তাঁদের প্রতি পুরো বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের যে আস্থা, সেই আস্থার জায়গা প্রশ্নবিদ্ধ করে।

প্রথম আলো:

ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে রাস্তা বন্ধ না করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আপনাদের অবস্থান কী হবে?

সারজিস আলম: পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ কর্মসূচি ঢাকার মানুষের স্বাধীনভাবে চলাচলের সমস্যা সৃষ্টি করছে। আমরা মনে করছি, সাময়িকভাবে জনদুর্ভোগ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ওই মানুষগুলোর কাছ থেকেই আমরা ব্যাপক হারে জনসমর্থন পাচ্ছি। ওই মানুষগুলোই ব্লকেডের সময় আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে বলছে, এটি যৌক্তিক আন্দোলন। দ্রুততম সময়ে এটি বাস্তবায়িত হওয়া উচিত। কারণ, কয়েক দিন পর আমার সন্তান এই পরিস্থিতির (কোটাব্যবস্থা) মুখোমুখি হবে। আমার আত্মীয়স্বজনকে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। পরবর্তী প্রজন্ম এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। তাই দ্রুত সমাধান হওয়া প্রয়োজন। ডিএমপি থেকে গতকাল জনদুর্ভোগের কথা বলায় আমরা ঢাকা শহরে এর আগের দিন শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০টির বেশি পয়েন্টে ব্লকেড দিয়েছিলাম। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে ব্লকেড দিয়েছিল। গতকালও আমরা সেই কথা বিবেচনা করে শুধু শাহবাগে ব্লকেড দিয়েছিলাম। বাকি অন্যান্য জায়গা থেকে ব্লকেড সরিয়ে নিয়েছি। আমরা তো আমাদের জায়গা থেকে ততটুকু সুবিবেচক—আমরা একই সঙ্গে পুরো দেশের কথা চিন্তা করি, দেশের মানুষের কথা চিন্তা করি, আমরা রাষ্ট্রের জন্যই কাজটি করছি। তরুণ প্রজন্মের জন্য কাজ করছি। সেই জায়গা থেকে সাময়িক জনদুর্ভোগ হচ্ছে, এটা আমরা স্বীকার করে নিচ্ছি। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এ দেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য এটি (কোটাব্যবস্থা) যে কত বড় সমস্যা, সেটি তারা ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে।

প্রথম আলো:

গত কয়েক দিনের আন্দোলনে শুধু রাজধানী নয়, বিভিন্ন স্থানে নাগরিক জীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আপনারা বিকল্প কিছু ভাবছেন কি না?

সারজিস আলম: আমরা কিন্তু এক দিনেই ব্লকেডে যাইনি। আমরা আমাদের কর্মসূচির অষ্টম দিন পর ব্লকেডে গেছি। তাহলে এই যে আমরা প্রথম আট দিন ক্যাম্পাসের ভেতরে বিক্ষোভ মিছিল করলাম, ক্যাম্পাসের বাইরে বিক্ষোভ মিছিল করে আবার ক্যাম্পাসে ফিরলাম। আমরা এক ঘণ্টার জন্য অবরোধ করলাম। তখন তো আমাদের যৌক্তিক এই দাবির দিকে কেউ লক্ষ করেনি। যদি সরকার থেকে বিষয়টাকে তখন আমলে নেওয়া হতো কিংবা এখনো যদি সরকার চায় এ বিষয়টা দ্রুততম সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে সংসদে আইন পাস করে, তাহলে তো আমরা রাস্তায় থাকব না।

বাংলাদেশে এখনকার বাস্তবতায় এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে আপনি যদি ওই মাত্রায় চাপ না সৃষ্টি করতে পারেন, তাহলে আপনি কারও মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারবেন না। যেটুকু করেছি, তা করতে হয়েছে সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য। যদি আমরা এটি না করতাম, হয়তো সরকার, সুশীল সমাজ, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা বিষয়টি নিয়ে এখন যতটা মনোযোগী হয়েছেন, ততটা হতেন না। আগেই মনোযোগী হলে এ পর্যন্ত আসতে হতো না। কিন্তু সরকারের জায়গা থেকে যদি আমাদের যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়া হয়, তাহলে তো আমরা ব্লকেডে যাব না। সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করে পড়াশোনায় ফিরব।