চট্টগ্রামের ১৬ আসনের ৭৫ শতাংশ ভোটকেন্দ্র ‘ঝুঁকিপূর্ণ’

২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের সময় চট্টগ্রাম সাতকানিয়ার খাগরিয়ায় দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেফাইল ছবি

দুই বছর আগে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ইউপি নির্বাচনে নলুয়া ইউনিয়ন বোর্ড কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও অস্ত্র নিয়ে হামলার ঘটনায় নিহত হয় স্কুলছাত্র মো. তাসিব। একই সময়ে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ পৌরসভা নির্বাচনে গাছবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের সামনে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের একপর্যায়ে গোলাগুলি হয়। কেন্দ্রের পাশে ছিলেন গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র হাবিবুর ইসলাম। গুলিতে তিনি গুরুতর আহত হয়ে মারা যান।

বিগত নির্বাচনে গোলাগুলির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ওই দুটি ভোটকেন্দ্রকে এবারও ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বা অধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে পুলিশ, যাতে এবারের নির্বাচনে আগাম নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা যায়। শুধু ওই দুটি কেন্দ্র নয়, এবারের সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামের ১৬ আসনের মোট ভোটকেন্দ্রের ৭৫ শতাংশই ‘ঝুঁকিপূর্ণ’। এবার ২ হাজার ২৩টি ভোটকেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৮৮টি কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। তবে পুলিশ বলছে, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে—আগের নির্বাচনে যেসব ভোটকেন্দ্রে গোলাগুলি, সংঘর্ষ হয়েছে; নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার পর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে; কেন্দ্রে ভোটার বেশি; ভোটকেন্দ্রের নিকটবর্তী প্রার্থীর বাড়ি; কেন্দ্রে একাধিক প্রার্থী প্রভাব বিস্তার করতে পারেন; কেন্দ্রটিতে সহজভাবে যাতায়াত করা যায় না এবং হেঁটে যেতে হয়।

চট্টগ্রামের ১৬ আসনের মধ্যে তিনটি পূর্ণাঙ্গ ও চারটি সংসদীয় আসনের আংশিক অবস্থান নগরে। জানতে চাইলে নগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় প্রথম আলোকে বলেন, নগরে ৬৬০টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৪৪৬টিকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে চারজন এবং কম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে তিনজন করে অস্ত্রধারী পুলিশ এবং ২ জন করে অস্ত্রধারীসহ ১৫ জন আনসার সদস্য মোতায়েন থাকবে। এর পাশাপাশি মোবাইল টিম, থানা এবং কন্ট্রোল রুমে স্ট্রাইকিং টিম থাকবে। সোয়াত, বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট ও ডগ স্কোয়াডের কে-নাইন ইউনিটকেও স্ট্রাইকিং হিসেবে রাখা হবে।

নির্বাচনকে ভীতিহীন করতে তিন আগে থেকে নির্বাচনের পর দিন পর্যন্ত পাঁচ দিনে নগর পুলিশের ৪ হাজারের বেশি সদস্য মোতায়েন থাকবে।

নগরে সংঘর্ষের কোনো ঘটনা না ঘটলেও জেলার সাতকানিয়া, বাঁশখালী ও পটিয়ায় নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার পর গোলাগুলি, হামলা-ভাঙচুর লেগে আছে। চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য নৌকা প্রতীকের আবু রেজা মো. নেজামুদ্দিন নদভী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ঈগল প্রতীকের সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মোতালেবের সমর্থকদের মধ্যে এ নিয়ে অন্তত ১০টি হামলা, ভাঙচুর ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০ জন। সংঘাতের জন্য দুই পক্ষই পরস্পরকে দোষারোপ করে আসছে। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি তিনটি মামলাও হয়েছে। এসব মামলায় সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও সবাই এখন জামিনে ছাড়া পেয়েছেন।

চট্টগ্রাম-১৬ বাঁশখালী আসনেও দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়। গত ১৯ ডিসেম্বর উপজেলা সদরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমানের সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান স্বতন্ত্র প্রার্থী দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুজিবুর রহমানের সমর্থকেরা। এ ঘটনায় থানায় দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি পৃথক দুটি মামলা করলেও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।

নির্বাচনী প্রচারণা ঘিরে চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনেও সংঘাত থামছেই না। গত ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর ১৩ দিনে সমর্থকদের ওপর ২২ বার হামলা হয়েছে বলে দাবি করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী (ঈগল)। ভাঙচুর করা হয়েছে অন্তত ১২টি গাড়ি, ৭টি নির্বাচনী ক্যাম্প। বেধড়ক মারধর করা হয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ভাই ও বোনকে। সন্দ্বীপেও দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা হয়।

পটিয়া, সাতকানিয়া, বাঁশখালীকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানান চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এস এম শফি উল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সুষ্ঠু ভোটের জন্য যা যা দরকার, সবই করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে পটিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় সংঘাতে জড়িত অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কাউকে ভোটকেন্দ্র দখল করতে দেওয়া হবে না।

র‍্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেনও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, চট্টগ্রামের পটিয়া, সাতকানিয়া, বাঁশখালীতে র‍্যাবের টহল জোরদার রয়েছে। ভোটার যাতে নির্ভয়ে কেন্দ্রে যেতে পারেন এবং ভোট গ্রহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। কেউ বাধা দিলে প্রতিহত করা হবে।

২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি চন্দনাইশ পৌরসভা নির্বাচনে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের গুলিতে নিহত কলেজছাত্রের মা ছকিনা খাতুন এখনো আতঙ্কিত। ছেলে খুনের মামলার বিচার তিনি এখনো পাননি। ছকিনা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, আসামিদের অনেকে জামিনে। ভোটকে ঘিরে আর কোনো মায়ের বুক যাতে খালি না হয়।

একই বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি ইউপি নির্বাচনে নিহত স্কুলছাত্র তাসিবের বাবা মো. জসিমের আতঙ্কও এখনো কাটেনি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখনো ভয় পাই নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা দেখলে। সংঘর্ষে আবার কোন মা-বাবা সন্তান হারা হন।