সবার জন্য শিল্প: ‘ডেয়ার’ ও বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক থিয়েটারের যাত্রা
ডিজঅ্যাবিলিটি আর্ট ও ইনক্লুসিভ থিয়েটারের এক দশকের যাত্রায় আমরা একটি মাইলফলকে এসে পৌঁছেছি। যার স্বপ্ন আমরা দীর্ঘকাল ধরে দেখেছিলাম। এই দীর্ঘদিনের কাজ, আমাদের শিল্পীদের অভিনয়ের মাধ্যমে হাজারো মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। গত কয়েক বছরের কাজ, কয়েক হাজার ঘণ্টার প্রশিক্ষণ ও ‘ডেয়ার’ প্রকল্পের মাধ্যমে তৈরি করা বিভিন্ন নাটক আগামী এপ্রিলে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডিজঅ্যাবিলিটি আর্ট ফেস্টিভ্যালে’ মঞ্চস্থ হবে।
ডেয়ার (ডিজঅ্যাবিলিটি আর্টস: রিডিফাইনিং এম্পাওয়ারমেন্ট) প্রকল্পটি ব্রিটিশ কাউন্সিল ও ঢাকা থিয়েটারের যৌথ অংশীদারত্বে শুরু হয়। ডেয়ার প্রকল্পের লক্ষ্য ডিজঅ্যাবিলিটি ও শিল্পকলা খাতের মধ্যে সেতুবন্ধসহ আস্থার জায়গা তৈরি করা।
২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশের আটটি বিভাগীয় শহরে ‘ইনক্লুসিভ থিয়েটার’ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক থিয়েটার চর্চার মাধ্যমে দুই শতাধিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও থিয়েটারশিল্পীর সঙ্গে আমরা নিবিড়ভাবে কাজ করছি। শৈল্পিক অঙ্গনে কাজ করার যাত্রায় ঢাকা থিয়েটার এবং নলেজ পার্টনার হিসেবে ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেটিক্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইআইডি) আমাদের সঙ্গে একত্রে কাজ করছে।
ব্রিটিশ কাউন্সিল ও ঢাকা থিয়েটার যৌথ উদ্যোগে প্রায় এক দশক ধরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মূল ধারার থিয়েটারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে কাজ করে যাচ্ছে।
২০১৩ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে প্রথমবারের মতো নাট্যকর্মশালা শুরু করা হয়। যেখানে যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্তিমূলক থিয়েটারের অন্যতম পুরোধা গ্রেআই থিয়েটার ও লন্ডন প্যারালিম্পিকের শৈল্পিক নির্দেশক জেনি সিলির সহযোগিতায় বাংলাদেশে এ ধরনের অনুশীলন শুরু করা হয়। ফলে ২০১৬ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশ ও লন্ডনের গ্রেআই থিয়েটার কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে প্রতিবন্ধী শিল্পীদের দিয়ে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের গল্প অবলম্বনে ‘আ ডিফারেন্ট রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়।
সেই যাত্রার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বুঝতে পারি, সমাজে অন্তর্ভুক্তির জন্য থিয়েটার আসলেই কতটা শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে। এই অনুধাবনের ফলাফল হচ্ছে, আমাদের এই ডেয়ার প্রকল্প। যার মাধ্যমে ২০১৯ সাল থেকে শুরু করে পরে বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছরে আমরা নির্মাণ করি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংলাপবিহীন নাটক ‘নৈঃশব্দ্যে ৭১ ’। এর নির্দেশনা দিয়েছেন গ্লাসগোভিত্তিক মঞ্চনির্দেশক রমেশ মেয়্যাপ্পান। বাক্-শ্রবণপ্রতিবন্ধী এই নির্মাতা ভিজ্যুয়াল ও ফিজিক্যাল থিয়েটার পদ্ধতির সমন্বয়ে ব্যতিক্রম এই নাটক তৈরি করেন। ডেয়ার প্রকল্পের অধীনে তৈরি এই নাটকে আটটি বিভাগের ১৫ জন প্রতিবন্ধীশিল্পী অভিনয় করেন।
বর্তমানে আমরা আটটি বিভাগীয় শহরের শিল্পীদের নিয়ে আটটি নাটক তৈরির কাজ করছি। এই আটটি প্রযোজনাসহ আরও দুটি প্রযোজনা এপ্রিলের শেষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী শিল্প উৎসবে মঞ্চস্থ হবে। পাশাপাশি থাকবে আলোচনা, সেমিনার, প্রদর্শনী, মার্কেটপ্লেস এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শিল্প ও নীতির ওপর চলচ্চিত্র প্রদর্শনী।
শিল্প এমন একটি সর্বজনীন ভাষা হিসেবে কাজ করে, যা ভাষা-সংস্কৃতি ও ক্ষমতার বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম। আবেগ ও বিবেকবোধ জাগ্রত করা, দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করা ও কথোপকথন সৃষ্টির একটি অনন্য ক্ষমতার অধিকারী এই মাধ্যম।
আমাদের বিশ্বে বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তি অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এখানে শিল্পের ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক চর্চা ভীষণ প্রয়োজন। সামাজিক অন্তর্ভুক্তির জন্য নানা প্রকার বাধা আছে। কাজটা নিতান্ত সহজ নয়। এ ক্ষেত্রে নানা ধরনের মানুষের সেতুবন্ধ, সহানুভূতি বৃদ্ধিতে শিল্পের রূপান্তরকারী শক্তিকে স্বীকৃতি দেওয়া অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
ইনক্লুসিভ থিয়েটার ব্যবস্থা প্রতিবন্ধী শিল্পীদের গল্প, অভিজ্ঞতা ও প্রতিভা শেয়ার করার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম প্রদান করে এই শক্তিকে প্রসারিত করে। এটি শুধু মানুষের অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যকে উদ্যাপন করে না, বরং সামাজিক নিয়মনীতির বাধাবিপত্তিকে চ্যালেঞ্জ করে।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সীমাহীন বাধার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। আমরা সব সময় বিশ্বাস করি, শিল্প মানুষকে সংযুক্ত করতে, আলোচনার জন্য জায়গা তৈরি করতে ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয়ে কুসংস্কার দূর করতে সাহায্য করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বৈচিত্র্যকে আলিঙ্গন করে এবং সক্রিয়ভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সৃজনশীল প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমেই আমরা পারি সমাজকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে। যেখানে সবার কথা আমরা জানতে পারব, সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে পারব। সমতা, বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডেয়ার তারই একটা উদাহরণ।
আগামী মাসে ইন্টারন্যাশনাল ডিজঅ্যাবিলিটি আর্ট ফেস্টিভ্যালের যে আয়োজন হতে যাচ্ছে, সেখানে সবাইকে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ। পাশাপাশি আমরা চাই, সবাই মিলে একসঙ্গে যেন এ যাত্রা অব্যাহত রাখতে পারি।
আমাদের সমাজটা সুন্দর করতে হলে কাউকে ফেলে রেখে আমরা কাজ করতে পারব না। বৈচিত্র্যই পারে আমাদের মাঝে নতুন সুন্দরের সৃষ্টি করতে, আমাদের শুদ্ধ মানুষে পরিণত করতে।
‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ মন্ত্র নিয়ে আমরা যেন সবাই মিলে এগিয়ে যাই—এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।