করোনাকালে বাড়লেও ক্রমেই কমছে স্টার্টআপে বিনিয়োগ, নীতি সহজ করার তাগিদ
দেশের স্টার্টআপ খাতে গত এক দশকে প্রায় ৯৮৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ এসেছে। দেশীয় মুদ্রায় যা সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে)। করোনাকালে পরপর দুই বছর এ খাতের বিনিয়োগে বেশ উঠতি প্রবণতা দেখা যায়। তবে পরের বছরগুলোয় ধারাবাহিকভাবে তা কমে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে স্টার্টআপে বিনিয়োগ আকর্ষণে দেশের আর্থিক নীতি সহজ করার তাগিদ দিয়েছেন এ খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
দেশীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লাইটক্যাসল পার্টনার্স গত বছরের নভেম্বরে ‘বাংলাদেশের স্টার্টআপে বিনিয়োগ প্রতিবেদন: এক দশকের পর্যালোচনা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, ২০১৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এক দশকে দেশের স্টার্টআপে ১১ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ এসেছে। এর মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ ৯২ শতাংশ।
দেশের বাজার না বোঝা ও ব্যবসায়িক ধারণাকে সঠিকভাবে মূল্যায়িত করতে না পারা একটি সমস্যা। দেশে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের ব্যবহার বেশ কম। অর্থাৎ ডিজিটাল সেবা নেওয়ার সুযোগ কম থাকায় স্টার্টআপের বাজারও বড় হয়নি।
এ এক দশকের শেষভাগে দুই বছর (২০২১ ও ২০২২ সাল) বাড়তি বিনিয়োগের পর তা কমে আসার পেছনে বৈশ্বিকভাবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, যুদ্ধের প্রভাব ও দেশীয় নীতির পাশাপাশি ডিজিটাল সেবা নেওয়ার বাজার বড় না হওয়াকে দায়ী করছেন খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
লাইটক্যাসল পার্টনার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ১ হাজার ২০০–এর বেশি স্টার্টআপ রয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত স্টার্টআপগুলোয় সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হয়েছে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের মাধ্যমে। আগামী বছরগুলোয় দেড় বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা এ খাতে; যদিও বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
হঠাৎ বিনিয়োগে উল্লম্ফন
লাইটক্যাসল পার্টনার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক দশকের মধ্যে ২০২১ সালে দেশের স্টার্টআপ খাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে। উল্লেখ্য, ওই বছর মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশে ২৫০ মিলিয়ন বা প্রায় ২৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে জাপানের সফট ব্যাংক।
তবে এ বিনিয়োগ ছাড়াও এককভাবে সর্বোচ্চ (৪৩ কোটি ৪৮ লাখ ডলার) বিনিয়োগ এসেছিল ২০২১ সালে। পরের বছর ২০২২ সালে বিনিয়োগ পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো থাকলেও ২০২৩ সাল থেকে তা আবারও কমতে শুরু করেছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালে বিনিয়োগ এসেছে ৩ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। আগের ছয় বছরের মধ্যে এটা সবচেয়ে কম।
প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশসহ ভারত, চীন, সিঙ্গাপুর ও পাকিস্তানের স্টার্টআপ খাতের বিনিয়োগ পরিস্থিতির তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেছে। তাতে দেখা গেছে, জিডিপির তুলনায় বাংলাদেশে স্টার্টআপে বিনিয়োগ সবচেয়ে কম।
স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম নিয়ে গবেষণা করা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘স্টার্টআপব্লিঙ্ক’ গত বছর ‘গ্লোবাল স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম ইনডেক্স ২০২৪’ প্রকাশ করেছে। তাতে বাংলাদেশ আগের বছরের চেয়ে ছয় ধাপ এগিয়ে ১০০টি দেশের মধ্যে ৮৩তম স্থানে রয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারত আছে ১৯তম, পাকিস্তান ৭১তম ও শ্রীলঙ্কা ৭৬তম অবস্থানে। অর্থাৎ তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবার নিচে।
বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতির প্রভাব ছাড়াও বিনিয়োগকারীদের নজর এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক স্টার্টআপে। বাংলাদেশে এমন উদ্যোগ কম।
যেসব চ্যালেঞ্জ
স্টার্টআপ খাতের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় দেশের অন্যতম শীর্ষ স্টার্টআপ ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম পাঠাওয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফাহিম আহমেদের সঙ্গে। তিনি এ খাতে তিন প্রধান চ্যালেঞ্জের কথা বললেন।
ফাহিম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের বাজার না বোঝা ও ব্যবসায়িক ধারণা সঠিকভাবে মূল্যায়িত করতে না পারা একটি সমস্যা। দেশের ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের ব্যবহার বেশ কম। অর্থাৎ ডিজিটাল সেবা নেওয়ার সুযোগ কম থাকায় স্টার্টআপের বাজারও বড় হয়নি। এ ছাড়া সেবা বা পণ্যের মানসহ বিনিয়োগকারীদের স্টার্টআপ বোঝার বিষয়টিও এখানে যুক্ত রয়েছে।’
অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা উদ্যোগ শিখোর সিইও শাহীর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার পর ডলারের দাম বেড়ে যায় এবং রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়ে স্টার্টআপ খাতে। বৈশ্বিকভাবেই ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বিনিয়োগ কমে যায়। এ ছাড়া বিনিয়োগকারীরা কোথাও বিনিয়োগ করার আগে সে দেশের স্থিতিশীলতা দেখে থাকেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বিনিয়োগকারীরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।’
দেশের স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে শাহীর চৌধুরী পরামর্শ, শেয়ারবাজার–নীতিসহ দেশের বিনিয়োগনীতি আরও সহজ করা।
বেশি বিনিয়োগ আর্থিক প্রযুক্তি খাতে
স্টার্টআপে দেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে ফিনটেক অর্থাৎ আর্থিক প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবসায়। এরপর আছে লজিস্টিক ও মোবালিটি, ই–কমার্স ও রিটেইল, স্বাস্থ্যসেবা, সফটওয়্যারভিত্তিক ব্যবসা।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে কয়েক বছর আগে স্টার্টআপ নীতিমালা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটার খসড়া পর্যায়ের কাজ এখনো চলছে। স্টার্টআপ উদ্যোক্তারা জানান, সঠিক কোনো নীতিমালা ও স্টার্টআপের ব্যাখ্যা না থাকায় অনেক সময় একে এসএমইর সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা হয়। এ ছাড়া দেশের ভেতরেও বিভিন্ন সুবিধা পেতে বেগ পেতে হয়।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আজকের ডিলের প্রতিষ্ঠাতা ও বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর প্রথম আলোকে বলেন, বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতির প্রভাব ছাড়াও বিনিয়োগকারীদের নজর এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক স্টার্টআপে। বাংলাদেশে এমন উদ্যোগ কম।
স্টার্টআপে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কম থাকার বিষয়ে ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘এ দেশের টাকাওয়ালা মানুষের একাংশ দেশের বাইরে টাকা নিয়ে যান। আরেকটা অংশ এখনো জমি ও ভবনে বিনিয়োগে আগ্রহী বেশি। কারণ, তাঁরা ঝুঁকি নিতে চান না।’ স্টার্টআপ বিনিয়োগ আকর্ষণে দেশের আর্থিক নীতি সহজ করার তাগিদ দিয়েছেন এই উদ্যোক্তা।