সাক্ষাৎকার
পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে: জেরিনা হোসেন
চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের একাংশের ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি অপারেটর নিয়োগ দিতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এ উদ্যোগের যৌক্তিকতা ও প্রভাব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন স্থপতি ও নগর-পরিকল্পনাবিদ জেরিনা হোসেন। সিলেট লিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের এই অধ্যাপক পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সুজন ঘোষ।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের একাংশের ব্যবস্থাপনা বেসরকারি অপারেটরকে দিচ্ছে সিডিএ। এটা কি যৌক্তিক?
জেরিনা হোসেন: এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। মানুষ একটু বিনোদনের জন্য, অবসর কাটানোর জন্য, মানসিক প্রশান্তির জন্য সমুদ্রসৈকতে যায়। কিন্তু কর্তৃপক্ষের এ ধরনের কাজকারবার জনগণের অধিকারকে সীমিত করবে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: এখন তো সেখানে টিকিট কেটে ঢুকতে হবে...
জেরিনা হোসেন: সমুদ্রসৈকত জনগণের সম্পদ। তাহলে জনগণকে কেন সেখানে টিকিট কেটে ঢুকতে হবে? এটা জনগণকে অবহেলার শামিল। টিকিট কাটার মানে হলো, যার সামর্থ্য আছে, সে সেখানে যেতে পারবে। যার নেই, সে যেতে পারবে না। আমি মাঝেমধ্যে ওই এলাকা দিয়ে যাই। যাওয়ার সময় সৈকতের বালুচরে বাচ্চাদের ফুটবল খেলতে দেখি। উন্মুক্ত পরিসর তাদের অধিকার। সেখানে টিকিট কেটে যেতে হবে, এটা মানা যায় না।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার আগে সংস্থাগুলো কি কারও পরামর্শ নেয় বা আলাপ করে?
জেরিনা হোসেন: নগর–পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের সঙ্গে আলাপ করতে তো কাউকে দেখা যায় না। তারা নিজেরা নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেয়। অথচ আমাদের সঙ্গে আলাপ করলে অনেক সুন্দর পরিকল্পনা বের হয়ে আসত।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: সিডিএ বলছে, সৈকতের ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তাদের টাকা নেই। অপারেটর নিয়োগ ছাড়া উপায় নেই।
জেরিনা হোসেন: অনেক অর্থ ব্যয়ে অতি উন্নয়নের তো দরকার নেই। সৈকতে পর্যটকদের জন্য কিছু সেবামূলক বা বিনোদনমূলক ব্যবস্থা নিয়ে টাকা আয় করা যায়, যা দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা চালানো যায়। তবে তা করতে হবে পরিকল্পনা অনুযায়ী। কিন্তু কোনোভাবেই সৈকতের একটি অংশ বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা দরকার।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: উন্মুক্ত পরিসর নিয়ে বারবার এমন পদক্ষেপ কেন?
জেরিনা হোসেন: এসব দেখলে দুঃখ লাগে। যেখানে আরও বেশি উন্মুক্ত পরিসর দরকার, সেখানে তা সীমিত করা হচ্ছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ইজারা দেওয়া হচ্ছে। আমি আসলেই বুঝতে পারছি না, কেন সৈকত এলাকা ইজারা দিতে হবে। এসব নিয়ে বারবার বলে যাচ্ছি। নগর উন্নয়ন নিয়ে, নগর-পরিকল্পনা নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা আলাপ-আলোচনা করতে চাই, বিতর্ক করতে চাই। কিন্তু তারা তা করবে না।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: সেবা সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা তো বারবার বিদেশ সফর করেন। তাঁরা আসলে সফর থেকে কী শেখেন?
জেরিনা হোসেন: মানুষের করের টাকায় নেওয়া প্রকল্পের আওতায় কর্তারা বিদেশ সফরে যান। তাঁরা একটু চোখ-কান খোলা রাখলে কত কিছুই শিখতে পারতেন। বাইরে উন্নয়নকাজ বলেন, পরিকল্পনা বলেন, সবকিছুতে সাধারণ মানুষকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের এখানে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে অবহেলিত হয়। তাদের সুযোগ-সুবিধা প্রাধান্য পায় না। আমাদের এখানকার সংস্থার বড় কর্তাদের মাথায় সাধারণ মানুষ নিয়ে ভাবনা নেই। তাঁরা ভাবেন বিত্তবানদের কথা।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: সৈকত যদি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চলে যায়, তাহলে কী প্রভাব পড়বে?
জেরিনা হোসেন: খুব বাজে প্রভাব পড়বে। মানুষের এমনিতেই কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। সৈকতে মানুষ যায় একটু অবসর কাটানোর জন্য। মানসিক প্রশান্তির জন্য। একজন মানুষের তো একান্তে কোথাও বসা দরকার। তার অবসর দরকার। বিনোদন দরকার। সৈকতে গেলে মানুষ তা পায়। সৈকতে বেশি যায় মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মানুষ। তাদের অন্য কোথাও যাওয়ার সামর্থ্য কম। এখন যদি টিকিটের বিনিময়ে সৈকতে যেতে হয়, তাহলে তারা নিরুৎসাহিত হবে। অধিকারবঞ্চিত হবে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: সিডিএর এ উদ্যোগের ব্যাপারে নাগরিক সমাজের অবস্থান কী হতে পারে?
জেরিনা হোসেন: সাধারণ মানুষকে এ উদ্যোগের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। যে রকম তারা সোচ্চার হয়েছিল সিআরবি রক্ষায়। নিজের সম্পদ, নিজেদের অধিকার রক্ষায় মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। তার কোনো বিকল্প নেই।