২৭ বছরে পার্বত্য চুক্তির মূলধারাগুলো বাস্তবায়িত হয়নি
ভূমি কমিশন, ভোটার তালিকা, জেলা ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচনের মতো মূল বিষয়গুলো উপেক্ষিত।
অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস পূর্তি উপলক্ষে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মতো পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ও তার কার্যক্রম তুলে ধরে। এসব কার্যক্রমের মধ্যে ছিল একনেকে ৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন, ১১টি কর্মশালার আয়োজন, মন্ত্রণালয়ের দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন এবং ত্রাণ কর্মসূচির জন্য কিছু খাদ্যশস্য ছাড়।
তবে সরকারের তিন মাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেনি মন্ত্রণালয়। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিতই হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে সম্পাদিত হয় এ চুক্তি।
চুক্তিকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। এটি সম্পাদনের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের আস্থায় নিতে হবে। সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। পাহাড়ে শান্তি আনতে এটা খুব দরকার।’সালাহউদ্দিন এম. আমিনুজ্জামান, অধ্যাপক, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি
আজ ২ ডিসেম্বর সেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৭তম বার্ষিকী। এত বছর পরও এ চুক্তির বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে মনে করছেন পাহাড়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ গবেষকেরা।
চুক্তির মাধ্যমে গঠিত তিন জেলা পরিষদ গত মাসে পুনর্গঠন করা হয়েছে পুরোনো ধারায় সরকার মনোনীত ব্যক্তিদের দিয়ে। এখন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ পুনর্গঠনের দাবি করছে চুক্তিবিরোধী আঞ্চলিক দল ইউপিডিএফ। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য গঠিত পরিবীক্ষণ কমিটি এখন পর্যন্ত নতুন করে গঠিত হয়নি।
চাকমা সার্কেলের প্রধান রাজা দেবাশীষ রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে আশার কিছু দেখছি না। বাস্তবায়নের দিকটি গতি পাবে, এমন কোনো ইঙ্গিতও নেই।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে দেশের প্রায় এক-দশমাংশ এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা সশস্ত্র লড়াইয়ের অবসান হয়। চুক্তিতে ৭২টি ধারা আছে। এর মাধ্যমে তিনটি জেলা পরিষদ এবং আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে আশার কিছু দেখছি না। বাস্তবায়নের দিকটি গতি পাবে, এমন কোনো ইঙ্গিতও নেই।চাকমা সার্কেলের প্রধান রাজা দেবাশীষ রায়
চুক্তির মূলধারাগুলোই বাস্তবায়ন হয়নি
চুক্তি হয়েছিল ১৯৯৭ সালে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। সে সময়ের বিরোধী দল বিএনপি চুক্তির বিরোধিতা করলেও ২০০১ সালে যখন ক্ষমতায় আসে, তখন তারা চুক্তি বাতিল করেনি; বরং চুক্তি অনুযায়ী একাধিক বিষয় হস্তান্তর করে জেলা পরিষদে। পার্বত্য মন্ত্রণালয়ে একজন উপমন্ত্রীও নিয়োগ দেওয়া হয়।
প্রতিবছর পার্বত্য চুক্তির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সময় চুক্তির কতগুলো ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে, তার একটি সংখ্যা তুলে ধরে সরকার। গত বছর বলা হয়, চুক্তির ৭২টির মধ্যে ৬৫টি ধারাই বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। কিন্তু জটিল ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য ভূমি কমিশন গঠন, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন, জেলা ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন, আঞ্চলিক পুলিশ বাহিনী গঠনের মতো মৌলিক ধারাগুলোই বাস্তবায়ন হয়নি। এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সুরাহা না হওয়ায় সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী জেএসএস প্রধান ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনেন একাধিকবার।
রয়ে গেছে পুরোনো ধারা
পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মপরিকল্পনা না এলেও আগের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে মনোনীত লোকদের মাধ্যমে তিন জেলা পরিষদ গঠন করা হয়েছে। গত মাসে (নভেম্বর) পরিষদ গঠন নিয়ে বিস্তর সমালোচনা আছে। বিশেষ করে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ নিয়ে পাহাড়িদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নয়, ১২ নভেম্বর খাগড়াছড়িতে এ নিয়োগ বাতিল চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য উশ্যেপ্রু মারমা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে এ নিয়ে আর কোনো তৎপরতা না চালাতে বলে দেওয়া হয়।’
জেলা পরিষদের গঠন নিয়ে গতানুগতিক পদ্ধতি অনুসরণের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম তো বাংলাদেশের বাইরে নয়। দেশের অন্যত্র যা হচ্ছে, এখানে তার ব্যতিক্রম কীভাবে হবে।
চুক্তির বাস্তবায়ন বিষয়ে এখন সরকারের কাছে থেকে কিছু শুনতে পাইনি। তারা বাস্তবায়ন করবে কি করবে না, কিছুই বলছে না।পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য গৌতম কুমার চাকমা
‘চুক্তিকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই’
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৩ নম্বর ধারাতেই এ চুক্তি বাস্তবায়নে একটি পরিবীক্ষণ কমিটি রাখার কথা আছে। তিন সদস্যের এ কমিটির আহ্বায়কের পদটি মন্ত্রীর পদমর্যাদার। সাবেক সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ প্রায় তিন বছর ধরে আহ্বায়ক ছিলেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ কমিটির আর কোনো কার্যকারিতা নেই।
পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারের কর্মপরিকল্পনা না থাকার বিষয়টি অবশ্য অস্বীকার করেছেন উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এসব বিষয় চিন্তা হিসেবে আছে, এক্সপ্রেস (প্রকাশ) হয়নি। দ্রুতই পরিবীক্ষণ কমিটিসহ নানা বিষয়ে পরিকল্পনা তুলে ধরা হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের পক্ষে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের কাজ করেন পরিষদের সদস্য গৌতম কুমার চাকমা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চুক্তির বাস্তবায়ন বিষয়ে এখন সরকারের কাছে থেকে কিছু শুনতে পাইনি। তারা বাস্তবায়ন করবে কি করবে না, কিছুই বলছে না।’
শুধু শান্তি স্থাপন না, পাহাড়ের আর্থসামাজিক উন্নয়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক শর্ত পূরণ না হওয়ায় পাহাড়ে এখনো সহিংসতা কমেনি।
পরিস্থিতির উন্নয়নে ভূমি সমস্যার সমাধানসহ চুক্তির মৌলিক দিকের বাস্তবায়ন দরকার বলেই মনে করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে একাধিক বইয়ের লেখক অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম. আমিনুজ্জামান। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপক বলেন, ‘চুক্তিকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। এটি সম্পাদনের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের আস্থায় নিতে হবে। সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। পাহাড়ে শান্তি আনতে এটা খুব দরকার।’