হত্যার বিচার চেয়ে মুখে লাল কাপড় বেঁধে মিছিল

দেশব্যাপী ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মুখে লাল কাপড় বেঁধে র‌্যালি করেন। মঙ্গলবার দুপুরে ক্যাম্পাসেছবি: শহীদুল ইসলাম

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ-সংঘাতে নিহতদের স্মরণ করে এবং এসব ঘটনার বিচার চেয়ে গতকাল মঙ্গলবার অনেকে ফেসবুকে নিজের প্রোফাইলে লাল রঙের ফ্রেম ব্যবহার করেছেন। দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা নিজেদের ক্যাম্পাস ও সড়কে মিছিলও করেছেন।

রাজধানী ঢাকায় বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকার বাইরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ সাতটি স্থানে গতকাল প্রতিবাদ কর্মসূচি হয়েছে। এর মধ্যে একটি স্থানে পুলিশ বাধা দিয়েছে।

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ-সংঘাতে এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে মঙ্গলবার (গতকাল) সারা দেশে শোক পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর রাতে কোটা আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক মুখ ও চোখে লাল কাপড় বেঁধে ছবি তোলা এবং তা অনলাইনে প্রচারের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার পরপরই গত সোমবার রাত থেকে ফেসবুকের প্রোফাইলে লাল রঙের ফ্রেম ব্যবহার শুরু হতে দেখা যায়। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী, লেখক, সাংবাদিক, চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অনেক মানুষ নিজেদের ফেসবুক প্রোফাইলে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সংহতি জানান।

জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ

ঘোষিত কর্মসূচি অনলাইনকেন্দ্রিক হলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিভিন্ন স্থানে গতকাল মিছিল হয়েছে। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে জড়ো হন ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর ব্যানারে’ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকেরা। তাঁদের সঙ্গে চোখেমুখে

লাল কাপড় বেঁধে সংহতি জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। পরে সেখান থেকে তাঁরা মৌন মিছিল বের করেন। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ঘুরে পুরোনো ফজিলাতুন্নেসা হলসংলগ্ন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে নবনির্মিত ছাত্র-জনতা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের সামনে যায়। সেখানে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। পরে সেখান থেকে পুনরায় মিছিল একই পথে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এসে শেষে হয়। এরপর সেখানে সমাবেশ করেন তাঁরা।

সমাবেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহমুদা আকন্দ, আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া, মোহাম্মদ মাফরুহী সাত্তার, রায়হান রাইন, সাঈদ ফেরদৌস, আদিল মুহাম্মদ খান, মো. মাসউদ ইমরান প্রমুখ বক্তব্য দেন। শিক্ষকেরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষদের হত্যা, তাঁদের ওপর হামলা, নির্যাতন ও আটকের ঘটনার প্রতিবাদ জানান।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকসমাজ’ ব্যানারে গতকাল দুপুর পৌনে ১২টার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের সামনে থেকে মাথায় ও মুখে লাল কাপড় বেঁধে মিছিল করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের দিকে যায়।

দেশব্যাপী ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মুখে লাল কাপড় বেঁধে র‌্যালি করেন নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষকবৃন্দ। মঙ্গলবার দুপুরে
ছবি: শহীদুল ইসলাম

ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে প্রধান ফটকের সামনে আগে থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকও ছিল তালাবদ্ধ। শিক্ষকেরা তালা খোলার অনুরোধ করলে পুলিশ তালা খুলতে বারণ করে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাকর্মী তালা খুলে দিলে শিক্ষকেরা প্রধান ফটকের সামনে সারিবদ্ধভাবে সমাবেশে মিলিত হতে থাকেন। এ সময় পুলিশের কর্মকর্তারা দ্রুত কর্মসূচি শেষ করার অনুরোধ করেন।

পরে শিক্ষকেরা সেখানে সমাবেশ করেন। শিক্ষকদের মধ্যে বক্তব্য দেন সালেহ হাসান নকীব, রায়হানা শামস ইসলাম, রেজাউল করিম, সাইফুল ইসলাম ফারুকী, ইসমত আরা, ফরিদ উদ্দিন খান, ইফতিখারুল আলম মাসউদ, ফরিদুল ইসলাম প্রমুখ।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংহতি

রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ক্যাম্পাসের বাইরে দাঁড়িয়ে কর্মসূচি পালন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শিক্ষকদের হাতে প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘নিরস্ত্র ছাত্র হত্যার বিচার চাই’, ‘শিক্ষার্থীদের পাশে শিক্ষক’ প্রভৃতি। শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের হয়রানি ও নিপীড়ন বন্ধের দাবি জানান। এই কর্মসূচিতে অন্যদের মধ্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নোভা আহমেদ, সাইফুল ইসলাম, মুশাররাত শর্মি হোসেন, সাকিব রহমান প্রমুখ অংশ নেন।

পাঁচ জেলায় প্রতিবাদ

আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত-বিচারসহ ৯ দফা দাবিতে গতকাল সকাল থেকে খুলনার শিববাড়ী মোড় ও এর আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে শুরু করেন। তবে পুলিশ তাঁদের সরিয়ে দেয়। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে শিক্ষার্থীদের একটি মিছিল শিববাড়ী মোড়ে আসে। পরে মোড়ের চারটি সড়ক অবরোধ করে বেলা দুইটা পর্যন্ত বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।

একই দাবিতে গতকাল দুপুর ১২টির দিকে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতাল চত্বর থেকে মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে কিছুটা এগোলেও পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা মহাসড়কে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কার্যালয়ের সামনে মিছিলটি থামিয়ে দেয় পুলিশ। পরে মহাসড়কে পুলিশ বেষ্টনীর মধ্যে বক্তব্য দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পঞ্চগড় জেলার অন্যতম সমন্বয়ক ফজলে রাব্বি। তাঁর বক্তব্যের পরপরই পুলিশের বাধায় সরে যান শিক্ষার্থীরা। এই কর্মসূচির আগে-পরে পাঁচজনকে আটক করে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।

পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার এস এম সিরাজুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচজনকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাঁদের অভিভাবকদের ডেকে কথা বলা হবে। তাঁদের মধ্যে নেতিবাচক কিছু পাওয়া না গেলে ছেড়ে দেওয়া হবে। আর নেতিবাচক কিছু পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সারা দেশে শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনার সুষ্ঠু বিচার, মুক্ত ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন দাবিতে বেলা ১১টার দিকে কিশোরগঞ্জের পুরোনো থানা এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। তাঁদের মাথায় লাল কাপড় বাঁধা ছিল, হাতে ছিল লাল রঙের প্ল্যাকার্ড। কর্মসূচিস্থলে বিপুলসংখ্যক পুলিশের অবস্থান ছিল। আধা ঘণ্টা পর শিক্ষার্থীরা রাস্তা ছেড়ে দিলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

ডিবি হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কের মুক্তিসহ বিভিন্ন দাবিতে গতকাল দুপুরে হবিগঞ্জ শহরের বসন্ত কুমারী গোপাল চন্দ সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে নিজেদের মুখে লাল কাপড় বেঁধে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড হাতে জড়ো হন হবিগঞ্জ সরকারি বৃন্দাবন কলেজ, হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ ও শচীন্দ্র ডিগ্রি কলেজসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রীরা। আধা ঘণ্টা অবস্থান করার পর পুলিশ এলে ছাত্রীরা কর্মসূচি শেষ করে চলে যান।

শিক্ষার্থী হত্যার প্রতিবাদ ও ৯ দফা দাবি আদায়ে গতকাল বিকেলে যশোরের কেশবপুরে সরকারি ডিগ্রি কলেজ মাঠে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। পরে বিকেল চারটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত যশোর-সাতক্ষীরা সড়ক অবরোধ করেন তাঁরা। পরে কলেজের মাঠে গিয়ে তাঁরা কর্মসূচি শেষ করেন। এই কর্মসূচির সময় পুলিশের বিপুল সদস্যের অবস্থান ছিল।