দুই বাহু প্রসারিত। বুক টান করে দাঁড়িয়ে আছেন অকুতোভয় যুবক। তাঁর পরিচয় আর কাউকে বলে দিতে হয় না। বীর আবু সাঈদ শুধু মহাকাল অতিক্রম করে চিরচেনা হয়ে থাকবেন। তাঁকেই প্রচ্ছদে ধারণ করে প্রকাশিত হলো প্রথম আলোর জুলাই-আগস্ট ২০২৪ ফটো জার্নাল ‘মুক্ত করো ভয়’।
এক অবিস্মরণীয় গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান করেছেন দেশের ছাত্র-জনতা। বৈষম্যমুক্ত, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন, মুক্ত ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছেন তাঁরা বিপুল আত্মত্যাগের বিনিময়ে। রাষ্ট্রবিপ্লবের আকাঙ্ক্ষায় রঙিন এই গণ-অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলো আমাদের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সংযোজন করেছে। প্রায় হাজারো তরুণ তাজা প্রাণের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে রাজপথ, আহত হয়েছেন অগণিত।
কর্তৃত্ববাদী শাসক তাঁদের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য নিয়োগ করেছেন সর্বশক্তি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিণত হয়েছিল তাদের হুকুমবরদারে। তারা ভয়ংকর মারণাস্ত্র দিয়ে নির্বিচার গুলি চালিয়েছে এ দেশেরই নিরস্ত্র নিরীহ প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার বুকে। এমনকি ঘরের মধ্য থেকেও রেহাই পায়নি নারী ও শিশুরা। সংঘর্ষ-কবলিত স্থানের আবাসিক এলাকায় মানুষের ঘরের ভেতরে প্রবেশ করেছে দূর থেকে ছোড়া বুলেট। কেড়ে নিয়েছে প্রাণ। রাজধানীসহ সারা দেশের রাজপথ পরিণত হয়েছিল যেন এক ভয়ংকর যুদ্ধক্ষেত্রে। তা সত্ত্বেও প্রতিবাদী ছাত্র-জনতা রাজপথ ছাড়েননি। চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত অসমসাহসিকতায় বীরদর্পে তাঁরা প্রতিবাদ, প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়েছেন। অবশেষে ৫ আগস্ট সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে বিজয়। যেন আবার এক নতুন মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করেছেন দমন নিষ্পেষণে বিষণ্ন জনতা। মেতে ওঠেন তাঁরা অপার আনন্দে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের এই দিনগুলোয় প্রথম আলোর ফটোসাংবাদিকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সরাসরি রাজপথে ছাত্র-জনতার সংগ্রামের ঘটনাগুলো ধারণ করেছেন তাঁদের ক্যামেরায়। এমনকি আহত হয়েছেন, তা সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রতিদিন প্রথম আলোর পাতায় ও অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে অজস্র ছবি। তার মধ্য থেকে বাছাই করে ৮৭টি ছবি নিয়ে সাজানো হয়েছে এই ফটো জার্নাল। এর সঙ্গে আছে সেই সময়ের ঘটনার ওপর ভিত্তি করে বেশ কিছু গ্রাফিকস, চিত্রকর্ম ও গ্রাফিতি, যা প্রকাশনাটিতে ভিন্নমাত্রা যুক্ত করেছে।
মলাট মেললে প্রথম ছবিটিই এক তুমুল প্রতিবাদের। একা এক যুবক পুলিশের সারির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ এই অবিস্মরণীয় স্লোগান পিঠে লিখে। গুলিস্তানে ৩০ জুলাইয়ের দৃশ্য। এরপর আছে টিএসসিতে ছাত্রদের প্রতিবাদী মিছিল, বাংলা ব্লকেড ঘোষণা নিয়ে রাজপথে নামা ছাত্রীরা, বিক্ষোভরত ছাত্রীদের ওপরে ছাত্রলীগ কর্মীদের লাঠিপেটা, অবিস্মরণীয় স্লোগান ‘তুমি কে আমি কে’ অবলম্বন করে গ্রাফিকস, ১৬ জুলাই বেলা ২টা ১৫ মিনিটে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সামনের বীর আবু সাঈদের সেই বুক টান করে দাঁড়ানোর দৃশ্য। এর অব্যবহিত পরেই তিনি গুলিবিদ্ধ হন। পাশেই তাঁর মায়ের উক্তি ‘হামার ব্যাটাক মারলু ক্যানে?’
ছবিতে আরও দেখা যাবে পথে পড়ে থাকা লাশ, মর্গে নিয়ে আসা লাশ, রাজপথে কাঁদানে গ্যাসের বিস্ফোরণ। রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রদের গ্রেপ্তার নিয়ে গ্রাফিকস ‘দিনে নাটক রাতে আটক’। পথে পথে সাঁজোয়া যান, বাস, উড়ালসেতুর টোল প্লাজায় আগুন। সিদ্ধিরগঞ্জের ছয়তলা বাড়ির গ্রিল ভেদ করে আসা বুলেটের চিহ্ন, যে বুলেটে নিহত হন গৃহবধূ সুমাইয়া আক্তার। ছাত্রদের লক্ষ্য করে পুলিশের গুলিবর্ষণ, গ্রেপ্তার, ছাত্র সমন্বয়কদের গ্রেপ্তার। শহীদ মিনারের গণসমাবেশ, অবশেষে স্বৈরশাসকের পতন ও দেশত্যাগ। জনতার উল্লাস, দেয়ালে দেয়ালে বিজয়ের গ্রাফিতি। এসব ধারণ করেই ফটো জার্নালের পাতার পর পাতাজুড়ে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান জাজ্বল্যমান হয়ে আছে।
কোনো ছবি ছাপা হয়েছে দুই পৃষ্ঠাজুড়ে। কোনোটি এক পৃষ্ঠায়, আবার একাধিক ছবিও আছে কোনো কোনো পৃষ্ঠায়। ছবিগুলোর সঙ্গে লেখা আছে সময়, স্থান, আলোকচিত্রীর নামসহ প্রয়োজনীয় তথ্য। এভাবেই সাজানো হয়েছে ১০৩ পৃষ্ঠার আর্ট পেপারে ছাপা জার্নালটি। প্রথম আলোর আলোকচিত্রীরা হলেন খালেদ সরকার, কবির হোসেন, মোহাম্মদ জাহিদুল করিম, আনিস মাহমুদ, মো. সাজিদ হোসেন, মঈনুল ইসলাম, সোয়েল রানা, সৌরভ দাশ, সাবিনা ইয়াসমিন, জুয়েল শীল, সৈয়দ আশরাফুল আলম, মো. সাইয়ান, সুমন ইউসুফ, মো. হাসান মাহমুদ, মো. সাদ্দাম হোসেন, মোহাম্মদ দিনার মাহমুদ ভূঁইয়া, শুভ্র কান্তি দাশ, মো. তানভীর আহাম্মেদ, দীপু মালাকার ও এম সাদেক। ডিজাইন করেছেন মাহবুব রহমান, পরিকল্পনা ও অলংকরণ করেছেন আরাফাত করিম, এস এম রাকিবুর রহমান। প্রচ্ছদ করেছেন আনিসুজ্জামান সোহেল। ইংরেজি অনুবাদ আয়েশা কবির।
প্রথম আলোর ২৬ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত কার্যক্রম এবার সাজানো হয়েছে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে ‘জেগেছে বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে। এরই অংশ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে এই ফটো জার্নাল। এটি শুধু নিছক একগুচ্ছ ছবির গ্রন্থনাই নয়, ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসেবেও মূল্যায়িত হবে।