মশা মারতে দুই বছর আগে বিটিআই ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিলেন গবেষকেরা

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত এলাকায় এখন এডিস মশার হটস্পট বেড়ে ৪৩৫টি হয়েছে
প্রতীকী ছবি: বাসস

ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশার উৎসস্থল ধ্বংসে বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস (বিটিআই) প্রয়োগ করতে যাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছর দুয়েক আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে বিটিআই প্রয়োগ করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। তখনই বিটিআই প্রয়োগ করলে এখনকার ডেঙ্গু পরিস্থিতি এতটা খারাপ না-ও হতে পারত।

নগরীতে মশকনিধন নিয়ে গবেষণা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। ২০২১ সালের আগস্টে গবেষণা প্রতিবেদনটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মিলনায়তনে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর উপস্থিতিতে উপস্থাপন করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে গবেষক দলের সদস্যসচিব এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক স্লাইড প্রদর্শনের মাধ্যমে গবেষণার তথ্য-উপাত্ত এবং সুপারিশ তুলে ধরেন। প্রতিবেদনে মশকনিধনের জন্য বিটিআই প্রয়োগের সুপারিশও করা হয়।

বিটিআই একধরনের ব্যাকটেরিয়া, যা লার্ভা ধ্বংস করে। তবে এটি প্রাপ্তবয়স্ক মশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এই ব্যাকটেরিয়া প্রাকৃতিকভাবে মাটিতেই জন্মায়। বিশ্বে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে এটির ব্যবহার চলছে। অনেক দেশ বিটিআই প্রয়োগ করে মশকনিধনে সফল হয়েছে।

যা ছিল সুপারিশে

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দলটি নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে মশার বিস্তার ও লার্ভা নিয়ন্ত্রণ এবং মশকনিধনে কার্যকর পদ্ধতি নির্ধারণের জন্য জরিপ চালায়। জরিপে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৫১টি জায়গায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গিয়েছিল। আর ১৫টি জায়গা ছিল এডিসের হটস্পট। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আহ্বানে এই গবেষণা চালানো হয়।

আরও পড়ুন

গবেষণা প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছিল, মশকনিধনে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে আনা গুরুত্বপূর্ণ। বিকল্প হিসেবে জৈব নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে বিশেষ প্রজাতির মাছ চাষ করে, অণুজীব কিংবা উদ্ভিদের নির্যাস ব্যবহার করে লার্ভা নিয়ন্ত্রণ ও ধ্বংস করা। এ ছাড়া দীর্ঘদিন কীটনাশক ব্যবহারের কারণে তা মশার ওপর কোনো প্রভাব ফেলছে কি না, তা যাচাই করে দেখতে মশার জিনগত বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের সুপারিশ করা হয়েছিল।

এ বিষয়ে আরও গবেষণা চালানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন গবেষকেরা। তাঁরা বলেছিলেন, ভবিষ্যতে যাতে মশা কিংবা মশার লার্ভা ধ্বংস করার জন্য কোনো ধরনের কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করার প্রয়োজন না হয়, সে জন্য বিস্তারিত গবেষণা করতে হবে।    

আরও পড়ুন

সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি

গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপনের বছর দুয়েক হতে চলেছে। কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করেনি। চলতি বছরের জরিপে সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত এলাকায় এডিস মশার হটস্পট বেড়ে ৪৩৫টি হয়েছে। এখন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মশকনিধনে বিটিআই প্রয়োগের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানার পর বছর দুয়েক আগের এই গবেষণা ও পরামর্শগুলো নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেক ডেঙ্গু রোগী। ১৬ জুলাই বেলা দেড়টায়, হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে
ছবি: সৌরভ দাশ

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ ও মশকনিধন কর্মকর্তা সরফুল ইসলাম বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মশকনিধনে বিটিআই প্রয়োগ শুরু করতে যাচ্ছে। এর আগে কলকাতাসহ বিভিন্ন শহরে এটা ব্যবহার করা হয়েছে। তবে আমাদের গবেষক দল মশকনিধনে সরাসরি ব্যাকটেরিয়া (বিটিআই) ব্যবহারের কথা বলেনি। তারা এই কাজে রাসায়নিকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে অণুজীব, উদ্ভিদের নির্যাস, মাছ চাষ ইত্যাদির কথা বলেছিলেন।

আরও পড়ুন

এ বিষয়ে গবেষক ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, মেয়রের সামনে উপস্থাপন করা লিখিত গবেষণা প্রতিবেদনে মশকনিধনে অণুজীব ব্যবহারের কথা উল্লেখ ছিল। প্রেজেন্টেশনের মধ্যে বিটিআই-সম্পর্কিত একটি স্লাইড প্রদর্শন করা হয়েছিল। কিন্তু সিটি করপোরেশন সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করেনি।

আমাদের গবেষক দল মশকনিধনে সরাসরি ব্যাকটেরিয়া (বিটিআই) ব্যবহারের কথা বলেনি। তারা এই কাজে রাসায়নিকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে অণুজীব, উদ্ভিদের নির্যাস, মাছ চাষ ইত্যাদির কথা বলেছিলেন।
সরফুল ইসলাম, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ ও মশকনিধন কর্মকর্তা।

বিটিআই কী

বিটিআই একধরনের ব্যাকটেরিয়া, যা লার্ভা ধ্বংস করে। তবে এটি প্রাপ্তবয়স্ক মশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এই ব্যাকটেরিয়া প্রাকৃতিকভাবে মাটিতেই জন্মায়। বিশ্বে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে এটির ব্যবহার চলছে। অনেক দেশ বিটিআই প্রয়োগ করে মশকনিধনে সফল হয়েছে। এসব তথ্য জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (সিডিসি)।

সংস্থাটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মশা, মাছি ও অন্যান্য পতঙ্গের লার্ভা মেরে ফেলে বিটিআই। লার্ভা ধ্বংস হওয়ার ফলে মশার সংখ্যা কমে যায়। মশার বংশবৃদ্ধি না হলে চিকুনগুনিয়া, ইয়োলো ফিভার, ডেঙ্গু ও জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমে আসে। মানুষের শরীরে বিটিআইয়ের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। পানিতে বিটিআই প্রয়োগ করলে অন্যান্য জলজ প্রাণীর কোনো ক্ষতি হয় না।

মেয়রের সামনে উপস্থাপন করা লিখিত গবেষণা প্রতিবেদনে মশকনিধনে অণুজীব ব্যবহারের কথা উল্লেখ ছিল। প্রেজেন্টেশনের মধ্যে বিটিআই সম্পর্কিত একটি স্লাইড প্রদর্শন করা হয়েছিল। কিন্তু সিটি করপোরেশন সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করেনি।
ওমর ফারুক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক।চট্টগ্রাম সিটি

যা করবে সিটি করপোরেশন

মশকনিধনে বিটিআই প্রয়োগের বিষয়ে গবেষক ওমর ফারুক বলেন, মশকনিধনে সিঙ্গাপুর, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে বিটিআই প্রয়োগ করা হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় সফলতার নজির রয়েছে। এখন ঢাকা উত্তর সিটির উদ্যোগটিও মশকনিধনে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মশকনিধন কর্মকর্তা সরফুল ইসলাম বলেন, ‘চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমিয়ে আনতে মশকনিধনে যা করা প্রয়োজন, তা করতে নির্দেশ দিয়েছেন মেয়র মহোদয়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে একটি টেকনিক্যাল কমিটি কাজ করছে। আমাদের এখানে এমন কোনো কমিটি নেই। ঢাকায় বিটিআই প্রয়োগের ফলাফলের ওপর আমাদের নজর থাকবে। এ ছাড়া আমরা মশকনিধনে নতুন নতুন কৌশলের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করব।’

আরও পড়ুন