কয়লাসংকটে বন্ধ হওয়ার এক মাস পর আবার চালু হতে যাচ্ছে বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। আগামী সপ্তাহ থেকে কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্র আবার চালু হতে পারে। ইতিমধ্যে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লার একটি জাহাজ দেশে এসে পৌঁছেছে। অন্যদিকে কয়লাসংকটে পটুয়াখালীর পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার যে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল, সেটিও আপাতত কেটেছে।
রামপাল চালু হলে এবং পায়রায় উৎপাদন বন্ধ না হলে দেশে চলমান লোডশেডিং বন্ধ হবে বলে আশা করছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা।
১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুই ইউনিটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বিনিয়োগে। চুক্তির প্রায় ১০ বছর পর গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে কেন্দ্রটি। কিন্তু কয়লার অভাবে ১৪ জানুয়ারি থেকে বন্ধ হয়ে যায় উৎপাদন। মূলত ডলার-সংকটে ঋণপত্র খুলতে না পারায় কয়লা আমদানি নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। একপর্যায়ে কয়লার অভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়।
টাকার সংস্থান করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাই আপাতত কোনো শঙ্কা নেই। কয়লা আমদানি হচ্ছে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ হচ্ছে না।এম খোরশেদুল আলম, বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনায় রয়েছে বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)। এই কোম্পানির একটি সূত্র বলছে, গতকাল বৃহস্পতিবার ৩০ হাজার টন কয়লা নিয়ে ইন্দোনেশিয়া থেকে একটি জাহাজ মোংলা বন্দরে এসে পৌঁছেছে। এ ছাড়া ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে আরেকটি জাহাজ ১৬ ফেব্রুয়ারি দেশে এসে পৌঁছাবে।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে দিনে ৫ হাজার টন কয়লা লাগে। সে হিসাবে ছয় দিনের কয়লা এসেছে। মাত্র ছয় দিনের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু করা যাবে না। তাই পরের জাহাজটি আসার অপেক্ষায় আছে তারা। ওই জাহাজ দেশের বন্দরে আসার পর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে।
বিআইএফপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাঈদ একরাম উল্লাহ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, দ্রুত উৎপাদন শুরুর চেষ্টা করছেন তাঁরা। আগামী সপ্তাহে এটি চালু হবে বলে তাঁরা আশাবাদী।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র বলছে, দেশে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কম চালানো হচ্ছে। আবার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে হঠাৎ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়। এখন প্রতিদিন গড়ে এক ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হচ্ছে। গতকাল সকাল আটটায় সর্বোচ্চ ৯৪১ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়েছে সারা দেশে।
যেকোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর আগে পিডিবিকে জানাতে হয়। এরপর বিদ্যুৎ উৎপাদন সূচির সঙ্গে তা সমন্বয় করে পিডিবি।
পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী সরদার প্রথম আলোকে বলেন, কয়লা দেশে আসার কথা জানিয়েছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। তবে কবে থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হবে, তা এখনো চূড়ান্ত করেনি কেন্দ্রটি।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট আছে। দ্বিতীয় ইউনিট আগামী এপ্রিল মাসে চালুর কথা রয়েছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্র বলছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট চালু হলে দিনে কয়লা লাগবে ১০ হাজার টন। বর্তমানে তাদের ৬ লাখ টন কয়লার ক্রয়াদেশ দেওয়া আছে। নতুন করে ডাকা দরপত্রে অংশ নিয়ে আরও ৬০ লাখ টন কয়লার ক্রয়াদেশ পেয়েছে দেশের বেসরকারি খাতের একটি শীর্ষ ব্যবসায়িক গ্রুপ। শুরু থেকে তারাই কয়লা সরবরাহ করছে এই কেন্দ্রে। ৬০ লাখ টন কয়লা দিয়ে আগামী তিন বছর রামপাল কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। ইন্দোনেশিয়া থেকে আনা হচ্ছে এসব কয়লা।
প্রথম ইউনিট চালুর পর রামপাল থেকে দিনে অন্তত ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ আসত ঢাকায়। বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের আগেই পিডিবিকে ডলার-সংকটের বিষয়টি জানায় রামপাল। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংককে বিষয়টি অবহিত করে বিদ্যুৎ বিভাগ। এ নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক হয়। এরপর ঋণপত্র খোলার ব্যবস্থা করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
২০১০ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের আওতায় নেওয়া হয় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প। ২০১২ সালে গঠিত হয় বিআইএফপিসিএল। ২০১৩ সালে পিডিবির সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি হয় ওই কোম্পানির। ২০১৬ সালের মধ্যে নির্মাণকাজ শুরুর কথা থাকলেও সেটি হয় ২০১৭ সালে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাওয়ার কথা ছিল কেন্দ্রটির। কিন্তু বারবার শুধু সময় পিছিয়েছে। সুন্দরবনের কাছে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে শুরু থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছেন পরিবেশবাদীরা।
আপাতত বন্ধ হচ্ছে না পায়রা
১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে পটুয়াখালীর কয়লাভিত্তিক পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। দিনে গড়ে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে কেন্দ্রটি। বিদ্যুৎ সরবরাহের দিক থেকে এটি দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র। বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশ-চীন পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) এটি নির্মাণ করে। ডলার-সংকটের কারণে কয়লা আমদানি নিয়ে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো একই সমস্যায় পড়েছিল পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র।
বিসিপিসি সূত্র বলছে, দীর্ঘদিন ধরে কয়লার টাকা বকেয়া রেখে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালিয়ে আসছে তারা। এতে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বকেয়া জমে যায়। গত জানুয়ারিতে কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দেয় সরবরাহকারী বিদেশি কোম্পানি। এরপর মজুতকৃত কয়লা দিয়ে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রটি। এমন পরিস্থিতিতে এ মাসেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়।
তবে বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম খোরশেদুল আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, টাকার সংস্থান করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাই আপাতত কোনো শঙ্কা নেই। কয়লা আমদানি হচ্ছে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ হচ্ছে না।
পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি। আর দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদন শুরু করে একই বছরের ২৬ আগস্ট। পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে চুক্তি করে পিডিবি। সঞ্চালন লাইনের জটিলতায় দেড় বছর ধরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একটি ইউনিট বন্ধ রাখতে হয়। এরপর বিকল্প উপায়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এখন অবশ্য ঢাকাতেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে কেন্দ্রটি।