জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে গ্রামের মেয়েদের জন্য স্কুলটি গড়েছেন রেখা রানী

নিজের গড়া স্কুলের সামনে রেখা রানী
ছবি: সংগৃহীত

‘আমাদের কলাবাড়ী’ নামের একটি ওয়েবসাইটে স্কুলটির বিভিন্ন তথ্য দেওয়া আছে। যেমন প্রতিষ্ঠানের নাম: কুমারী রেখা রানী গার্লস হাইস্কুল, বুরুয়া। প্রতিষ্ঠাতা: কুমারী রেখা রানী ওঝা। স্থাপিত: ২০১৪।

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার কলাবাড়ী ইউনিয়নের বুরুয়া গ্রামে দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের জন্য জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে নিজের নামে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছেন রেখা রানী ওঝা। সম্প্রতি ক্যামেরার সামনে তিনি তাঁর স্কুলকে নিয়ে কিছু আকুতি জানান। সেই ভিডিওতে বলা রেখা রানীর কথাগুলো নিয়ে এখন ফেসবুকসহ বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা হচ্ছে।

স্কুলটিতে বর্তমানে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েরা পড়ছে। স্কুলে একটি হোস্টেলও করে দিয়েছেন রেখা রানী, যাতে মেয়েদের দূর থেকে আসতে কষ্ট না হয়। এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কয়েকজন হোস্টেলে থেকে তাঁর তত্ত্বাবধানে পরীক্ষা দিচ্ছে। রেখা রানী জানালেন, শুরুতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্কুলের জন্য ছাত্রী খুঁজে বের করার কাজও করেছেন তিনি।

রেখা রানী সরকারি হাসপাতালের নার্স ছিলেন। অবসরে যাওয়ার পর পেনশনের টাকা দিয়ে জমি কিনে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৮৩ সালে রেখা সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে যোগ দেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাজধানীর মিরপুরে ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতাল থেকে অবসরে যান ২০১১ সালে।

রেখা রানীর সংগ্রাম

রেখা রানীর জন্ম ১৯৪৮ সালে। পড়াশোনা বন্ধ করে বাবা বিয়ে দিতে চেয়েছেন বহুবার। তবে ছোটবেলা থেকেই রেখার জেদের কাছে হার মেনেছেন বাবা। কখনো বাড়ি থেকে পালিয়ে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে, আবার কখনো কখনো কোনো আত্মীয়ের সহায়তায় রেখা পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। ঢাকার নার্সিং ইনস্টিটিউট থেকে পড়াশোনা করে এটাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কাজ করেছেন বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে।

স্কুলের লাইব্রেরির এক কোণেই থাকেন রেখা রানী সরকার। ঢাকায় এলে থাকেন এক ভাইয়ের বাসায়। মোবাইলে কথা হলো রেখা রানী ওঝার সঙ্গে। তাঁর স্কুল এবং জীবনের গল্প শুনতে চাইলে বললেন, ‘আমার জীবনের যে গল্প, তা শুনলে শুধু মোবাইলের টাকা ফুরাবে, গল্প শেষ হবে না।’

রেখা রানী জানালেন, নিজের খরচ চালানোর জন্য যাত্রাপালায় অভিনয় করেছেন একসময়। ওষুধের দোকান চালিয়েছেন। এ জীবনে অনেক ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করার জন্য সহায়তা করেছেন। তাঁদের অনেকেই এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত। বললেন, তিনি এত দূর আসতে কারও কাছে হাত পাতেননি। তবে এখন আর পারছেন না। ক্যানসারসহ স্বাস্থ্যগত নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে। স্কুলটি চালাতে কষ্ট হচ্ছে। শিক্ষকদের বেতন দিতে পারছেন না বলে শিক্ষকেরা চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। যদিও শিক্ষকেরা এমপিওভুক্ত না হওয়া পর্যন্ত বিনা বেতনেই পড়াবেন এমন শর্তেই যোগ দিয়েছেন।

স্কুলটিতে মেয়েদের পড়ার জন্য ভর্তির সময় যে যা দেয়, তাই নেন রেখা রানী। পরীক্ষার সময় সরকারি নিবন্ধনের খরচ ছাড়া মেয়েদের কাছ থেকে বেতন নেন না। বললেন, এরা দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। বাবা–মা একটু সুযোগ পেলেই ধরে ধরে বিয়ে দিয়ে দেন। তাই যেভাবেই হোক মেয়েদের স্কুলে ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন রেখা রানী।

এবার এই বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে ২৬ জন ছাত্রী। তাদের মধ্যে হোস্টেলে ১০ জনের মতো আছে। রেখা রানী বলেন, মেয়েদের অভিভাবকদের বলা হয়েছে যাঁর বাড়িতে শাকসবজি হয়, তিনি যেন তা মেয়েদের জন্য পাঠিয়ে দেন। চাল-ডাল পাঠিয়ে দেন। সেভাবেই অভিভাবকদের পাঠানো খাবার খাচ্ছে মেয়েরা।

২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর স্কুলটির উদ্বোধন হয়। এরপর একদিকে চলে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড থেকে অনুমতি পাওয়ার চেষ্টা। ২০১৯ সালে স্কুলটি ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর অনুমতি পায়। এরপর মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ানোর অনুমতি পাওয়া যায়। এর আগে অবশ্য স্কুলটি নিজেদের মতো করে চলে।

বর্তমানে স্কুলে ছাত্রীসংখ্যা ১০০। শিক্ষক আছেন ৯ জন। টিনশেড ঘরে একজন ছাত্রীকে দিয়ে স্কুলের উদ্বোধন করেছিলেন রেখা রানী। সরকারি অর্থায়নে একতলা ভবন হয়েছে।

রেখা রানী জানালেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই স্কুলটিই এলাকার মেয়েদের একমাত্র ভরসা। ছেলেদের জন্য এমপিওভুক্ত একটি স্কুল আছে।

স্কুলটি এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করেছেন রেখা রানী। বললেন, শিক্ষকদের বেতন নেই, শিক্ষকেরা সরকারি চাকরি পেয়ে চলে যাচ্ছেন। তাঁদের দোষ দেওয়ারও উপায় নেই।

স্কুলের মাঠে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রেখা রানী
ছবি: সংগৃহীত

রেখা রানী বললেন, ‘নিজের সব সঞ্চয় দিয়ে স্কুলটি বানিয়েছি। আমি চাই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি একবার স্কুলে এসে স্কুলটি দেখে যাবেন। আমি খুব অসুস্থ। এই আছি, এই নেই। স্কুলটির জন্য যা ভালো হয়, তাই করবেন প্রধানমন্ত্রী।’

আলাপে আলাপে জানা গেল রেখা রানী বিয়ে করেননি। তবে তিনি চন্দনা রানী বৈদ্য নামের এক মেয়ের মা। ঢাকায় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন চন্দনা। টিউশনির পাশাপাশি এখন একটি চাকরি খুঁজছেন। কথা হলো চন্দনার সঙ্গে। জানালেন, তিনি রেখা রানীর দত্তক মেয়ে। নিজের মা মারা যাওয়ার পর তাঁর বাবা আবার বিয়ে করেন। তারপর তাঁর দায়িত্ব পরিবারের কেউ নিতে চাননি। মা মারা যাওয়ার দুই বছরের মাথায় রেখা রানীর কাছে আশ্রয় পান।

চন্দনা রানী বললেন, ‘শ্রীকৃষ্ণ যেমন যশোদার সন্তান, আমিও তেমনি মামণির সন্তান। আমি তাঁর স্কুল প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সাক্ষী। মামণি যদি স্কুলের শিক্ষকেরা বেতন পাচ্ছেন, এটা দেখে যেতে পারেন, তাহলে সবচেয়ে খুশি হবেন।’

চন্দনা বললেন, মাঝেমধ্যে এমনও হয়, ঘরে বাজার নেই, আলুভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে দিন পার করতে হয়। অভিমানও হয়। কিন্তু তারপর ভাবি, মামণি একটি স্কুলের জন্য সংগ্রাম করছেন। স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হলে পিছিয়ে পড়া মেয়েরা পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে।

রেখা রানীর স্বপ্ন

২০১৯ সালে স্কুল থেকে জেএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৯৪ শতাংশ। আর ২০২১ সালে স্কুলটিতে মাধ্যমিক পাসের হার ছিল ৮৯ শতাংশ। পরের বছর তা হয় শতভাগ। গত বছর রেখা রানী চিকিৎসার জন্য ভারতে থাকায় তুলনামূলক ফলাফল কিছুটা খারাপ হয় বলে জানালেন। তবে এবার ভালো ফলাফল নিয়ে আশাবাদী তিনি।

রেখা রানী বাবা-মাকে হারিয়েছেন অনেক আগেই। তাঁর ভাই–বোনেরা নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তাঁর সঞ্চয় বলতে কিছু নেই। জমি আছে পৌনে দুই বিঘার মতো। রেখা রানী হাতের কাজ করেন, ঢাকায় মেয়ে টিউশনি করেন।

কলেজের অধ্যাপক বা বড় কিছু হতে চেয়েছিলেন রেখা রানী। নিজে তা হতে না পারলেও স্বপ্ন দেখেন তাঁর স্কুলের মেয়েরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে।

গোপালগঞ্জের জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মুহাম্মদ সিদ্দিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, স্কুলটি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানতে পেরেছেন। তবে এমপিওভুক্তির জন্য বিভিন্ন শর্ত পূরণ করতে হয়। সেসব শর্ত পূরণ হলে এতে আপত্তি জানানোর কিছু নেই।

১ নম্বর কলাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আইনজীবী বিজন বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের তুলনায় রেখা রানীর স্কুলটি বেশ ভালো। তিনি নার্স ছিলেন, নিজের স্বপ্ন পূরণে চাকরি ছেড়ে স্কুল বানিয়েছেন। স্কুলে শিক্ষকেরা বিনা বেতনে চাকরি করেন। রেখা রানী বর্তমানে মারাত্মক অসুস্থ। স্কুলের পেছনে তাঁর যে অবদান, এলাকার সবাই তা জানেন।

বিজন বিশ্বাসের মতে, রেখা রানীর স্কুলের সমস্যা দূর করতে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

রেখা রানী নিজের জীবন নিয়ে এখন আর তেমন কথা বলতে চান না। বললেন, ‘আমার জীবনটা কষ্টের, আর সেই কষ্টের কথা শুনে কী করবেন? তার চেয়ে আমার স্কুলটির কষ্ট যাতে দূর হয়, তেমন কিছু করেন।’