চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের রাজস্ব আদায় কম, আয় বাড়াতে তোড়জোড়
দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজস্ব আদায় কমেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের। অর্থবছরের শুরুতে এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় নড়েচড়ে বসেছে সংস্থাটি। রাজস্ব আদায় বাড়াতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সক্রিয় হতে চিঠি দিয়েছে। আয় বাড়াতে রাজস্ব কার্যালয়ে যাবেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ১৬ জুলাই থেকে চট্টগ্রাম উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ওই দিন চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে ছাত্র ও যুবলীগের সংঘর্ষে চারজনের মৃত্যু হয়। এরপর চট্টগ্রামে ধারাবাহিকভাবে মিছিল-সমাবেশ চলতে থাকে। এসব কর্মসূচিতে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই সময়ে সারা দেশের মতো চট্টগ্রামেও কারফিউ জারি করা হয়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। এরপর আত্মগোপনে চলে যান সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীসহ ওয়ার্ড কাউন্সিলররাও। অবশ্য এখন কিছু কিছু ওয়ার্ডে কাউন্সিলররা অফিস শুরু করলেও প্রধান কার্যালয়ে আসছেন না মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। এই অবস্থায় সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম স্থবির হওয়ার উপক্রম হয়। এখন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রশাসনিক ও আর্থিক দায়িত্ব দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
সিটি করপোরেশনের রাজস্ব আদায়ের তথ্য অনুযায়ী, রাজস্ব আয়ের ৯টি খাত রয়েছে। অর্থবছরের শুরুতে ১ জুলাই থেকে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত গৃহকর ছাড়া সব খাতেই আয় কমেছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ সাড়ে ৪০ কোটি টাকা পরিশোধ করায় গৃহকর খাতে আয় বেড়েছে। রাজস্ব আয় দিয়ে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। নেওয়া হয় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প।
সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এখন পর্যন্ত কাগজে-কলমে রাজস্ব আদায় বেড়েছে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। গত অর্থবছরে এই সময়ে বেসরকারি খাত থেকে আয় হয়েছিল প্রায় ১৩ কোটি টাকা। কিন্তু এই বছর আয় হয়েছে ১০ কোটি টাকা। বন্দর কর্তৃপক্ষ এবার জুলাই মাসে গৃহকর পরিশোধ করেছে। অন্যান্য বছর তা আগস্টের শেষে কিংবা সেপ্টেম্বরের শুরুতে দিত।
কর্মকর্তারা জানান, বন্দর কর্তৃপক্ষের টাকা ছাড়া এখন পর্যন্ত মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। অথচ গত অর্থবছরে আদায় হয়েছিল ৪৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে অনুষ্ঠিত সমন্বিত সভায়।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, গৃহকর ছাড়া রাজস্ব আদায়ের অন্যতম বড় খাত ট্রেড লাইসেন্স ফি। গত অর্থবছরে যেখানে ১ জুলাই থেকে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত আয় হয়েছিল ৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা, এবার সেখানে আয় হয়েছে ৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা; অর্থাৎ আদায় কমেছে ১ কোটি ৮২ লাখ টাকা।
নতুন ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু এবং পুরোনো ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের সংখ্যাও কমেছে। গত বছর এই সময়ে নতুন ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছিল ২ হাজার ১১৯টি এবং নবায়ন করা হয়েছিল ২৬ হাজার ৫৫৫টি। এবার ইস্যু করা হয়েছে ১ হাজার ৩৫২টি। আর নবায়ন করা হয় ১৯ হাজার ৪৫৯টি।
সিটি করপোরেশনের ভূ-সম্পত্তি বিভাগ থেকে আয় হয়েছিল ৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা। কিন্তু এবার আদায় হয়েছে ২ কোটি ২৪ লাখ টাকা; অর্থাৎ ১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা কম আদায় হয়েছে। দোকান ভাড়া, হাটবাজার, শৌচাগার, ঘাট ইজারা থেকে এই টাকা আসে।
সিটি করপোরেশন প্রতি অর্থবছরে রেজিস্ট্রার কার্যালয় থেকে বড় অঙ্কের ভূমি হস্তান্তর ফি পায়। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এবার ৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা কম পেয়েছে সিটি করপোরেশন। গতবার এই সময়ে পেয়েছিল ১৮ কোটি ২৮ লাখ টাকা, এখন পাওয়া গেছে ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় কর কর্মকর্তাদের গত বুধবার চিঠি দিয়েছেন সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন। চিঠিতে বলা হয়, গৃহকর ও ট্রেড লাইসেন্স ফি আদায় প্রতিবেদন অনুযায়ী বাৎসারিক দাবির বিপরীতে কর আদায়ের হার খুবই হতাশাজনক। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কর আদায়ের জন্য মাঠপর্যায়ের কর কর্মকর্তা, উপকর কর্মকর্তা, ক্রোকি কর্মকর্তা, কর আদায়কারী, লাইসেন্স পরিদর্শকদের আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে এবং কর আদায় বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গৃহকরসহ প্রায় সব খাতে আদায় কমেছে। রাজস্ব আদায় কম হওয়ার বিষয়টি তাঁদের এক বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। রাজস্ব আদায় কমতে থাকলে বেতন-ভাতা পরিশোধ এবং উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। কর আদায় বৃদ্ধি করতে কর্মকর্তাদেরও রাজস্ব কার্যালয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।