বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলার তদন্তের দায়িত্ব চায় দুদক
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নরসহ ১৪ জনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।
রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি ঘটেছে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে, কিন্তু মামলায় চুরির ধারা দেওয়া হয়।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার সরিয়ে নিয়েছিল হ্যাকাররা। ওই ঘটনায় মতিঝিল থানায় যে মামলা হয়েছিল, তার তদন্ত ৯ বছরেও শেষ করতে পারেনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এখন মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব চাইছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানসহ ১৪ জনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে সিআইডি। ইতিমধ্যে তাঁদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইমিগ্রেশন পুলিশ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ। সাবেক শেখ হাসিনা সরকার ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে একটি সাজানো মামলা করে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিল সিআইডিকে। ঘটনার ৩৯ দিন পর মতিঝিল থানায় মামলা করা হয়। মামলায় চুরিসহ তিনটি ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ওই কর্মকর্তা বলেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি ঘটেছে মূলত হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে, কিন্তু মামলায় কৌশলে চুরির ধারা দেওয়া হয়। আইনে হ্যাকিংয়ের স্পষ্ট ধারা থাকলেও সেটি মামলায় উল্লেখ করা হয়নি, যাতে অভিযোগপত্র দিলেও মামলাটি বিচারে গিয়ে আসামিরা ছাড় পান। আসামিদের সুবিধা দিতেই এই ধারা যুক্ত করা হয়।
৩১ ডিসেম্বর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব চেয়ে সিআইডিকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে এখনো সিআইডি থেকে উত্তর পাওয়া যায়নি।
দুদক সূত্র বলছে, গত ৩১ ডিসেম্বর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব চেয়ে সিআইডিকে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। ২ জানুয়ারি দুদকের চিঠিটি পেয়েছে সিআইডি। তবে এখনো সিআইডি থেকে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি।
বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা পাওয়া ১৪ জনের মধ্যে ৪ জন ছাড়া অন্যদের নাম–পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান, সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট ও ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক পরিচালক আনিসউদ্দিন আহমেদ খান ওরফে আনিস এ খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মেইন্টেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার দিপঙ্কর কুমার চৌধুরী, সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক এস এম রেজাউল করিম, সাবেক নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহা, মামলার বাদী জুবায়ের বিন হুদা, সাবেক উপপরিচালক (সুইফট অপারেটর) জি এম আব্দুল্লাহ সালেহীন, সহকারী পরিচালক শেখ রিয়াজ উদ্দিন, কর্মকর্তা একলাস উদ্দিন ও বর্তমান নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আগেই দেশ ছেড়ে গেছেন আতিউর রহমান। তবে অন্যরা এখনো দেশে আছেন।
রিজার্ভ চুরির ঘটনায় মামলার সিডি, আলামতসহ অন্যান্য রেকর্ডপত্র চেয়ে সিআইডির কাছে পাঠানো দুদকের চিঠিতে বলা হয়েছে, দণ্ডবিধির ২১ ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ও ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নরসহ জড়িত কর্মকর্তারা সরকারি কর্মচারী বা পাবলিক সার্ভেন্ট। এটা দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ। তাই মামলাটি দুদকের কাছে হস্তান্তরের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইডির কোনো কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে দুদকের চিঠির বিষয়টি জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বিষয়টি জানেন না। খোঁজ নিয়ে পরে জানাতে পারবেন।
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয়। দুর্বৃত্তরা সুইফট পেমেন্ট পদ্ধতিতে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ওই বিপুল পরিমাণ টাকা সরিয়ে নেয়। এই অর্থ ফিলিপাইনের মাকাতি শহরে রিজাল ব্যাংকের শাখায় চারটি অ্যাকাউন্টে যায় এবং সেখান থেকে দ্রুত টাকা উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে ৩৪ শতাংশ অর্থ ফেরত পাওয়া গেছে। বাকিটা এখনো ফিলিপাইনের একটি ব্যাংকে জমা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ফিলিপাইন ব্যাংকের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে একটি মামলা করেছে। মামলায় জিততে পারলে বাকি টাকা ফেরত পাওয়া যাবে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সুইফট সিস্টেমের নিরাপত্তাব্যবস্থা সংরক্ষণে অবহেলা ও গাফিলতির কারণে হ্যাকাররা দেশের রিজার্ভের টাকা সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন রিজার্ভ সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) সার্ভার একটি সংবেদনশীল ব্যবস্থা। তা সত্ত্বেও গভর্নর সুইফটের মাধ্যমে আরটিজিএসের (রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট) সংযোগ করার অনুমোদন দেন এবং বাস্তবায়ন নিশ্চিত করেন। এটাকে অপরাধমূলক উদ্দেশ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তদন্তকারীরা। আরটিজিএস একটি বিশেষায়িত তহবিল স্থানান্তর ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে তাৎক্ষণিক তহবিল স্থানান্তর করা যায়।
তদন্তে আরও এসেছে, তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর-৪ আবুল কাশেম সুইফটের মাধ্যমে আরটিজিএস সার্ভিস প্রদানের বিপক্ষে ছিলেন। যার কারণে আরটিজিএসের সার্ভিস দেওয়া-সংক্রান্ত ফাইল গভর্নর আতিউর রহমান নিজে সই করে অনুমোদন দেন। আর্থিকভাবে লাভবান হতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কোনো কর্মকর্তা হ্যাকারদের সঙ্গে যোগসাজশ গড়েছিলেন। যদিও বিষয়টি ধরা পড়ার পর তাঁরা টাকার ভাগ পাননি।
জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব হস্তান্তরের আগে অ্যাটর্নি জেনারেলের পরামর্শ নেওয়া উচিত। মামলাটি যথাযথভাবে তদন্ত হয়েছে, নাকি কোনো ধরনের ভুলত্রুটি রয়ে গেছে, সেটা বিবেচনায় নিয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন।