প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে
কথা শেষ না হতেই শুরু হলো ব্রাশফায়ার
মাত্র দু-হাত দূরত্বের মধ্য থেকে শুরু হলো ব্রাশফায়ার। তখনো আমার হাত ধরে ছিলেন আব্বা। এই প্রথমবার আমি চিত্কার করে জড়িয়ে ধরলাম আব্বাকে। আবার দ্বিতীয় রাউন্ড। মাটিতে পড়ে গেলাম। মনে হলো আব্বাও উপুড় হয়ে পড়লেন।
তখন আমরা থাকতাম মিন্টো রোডের ২৭ নম্বর বাসায়। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট। আর দশটা দিনের মতোই ব্যস্ততায় কেটেছে দিনটি। সেদিন ছিল আমার দাদির মৃত্যুবার্ষিকী। প্রতিবছর এই দিনটিতে আব্বা বরিশাল যান। কিন্তু ওই দিন কোনো বিশেষ কারণে যেতে পারেননি।
তাই মিন্টো রোডের বাসাতেই মিলাদ পড়ানো হলো। রাতে বড় মামা (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) ছাড়া তাঁর ও মনি (শেখ ফজলুল হক) ভাইয়ের পরিবারসহ আমাদের নিকট আত্মীয়রা এসেছিলেন বাসায়। মিলাদের পর রাসেল, আমাদের সবার ছোট ভাই আরিফ, বড় ভাইয়ের (আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ) ছেলে বাবু ও অন্য বাচ্চারা চোর-পুলিশ খেলছিল। আমরা অনেকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে গল্প করছিলাম।
রাত ১০টা নাগাদ আত্মীয়স্বজন বিদায় নিলেন একে একে। আব্বা সন্ধ্যারাতে বাসায় এসে আবার বাইরে গিয়েছিলেন। কী যেন জরুরি বৈঠক ছিল। মামাও ছিলেন সেখানে। সাড়ে ১০টার দিকে চলে এলেন আব্বা। আমরা খেতে বসলাম তাঁর সঙ্গে। রাতের বেলা খাবারের টেবিল ছাড়া সাধারণত আব্বার সাক্ষাৎ খুব একটা পেতাম না আমরা। খেতে বসেই আমাদের পড়াশোনার খোঁজ নিতেন তিনি। খাওয়া শেষ হলো। যে যার রুমে চলে গেলাম।ন
এভাবেই চলতে লাগল অনেক দিন। প্রায় তিন মাস ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুর্বিষহ দিন কাটিয়েছি। পরে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে চিকিৎসার জন্য গিয়েছি ভারতে।
আমি আর ছোট বোন বেবী এক ঘরেই থাকতাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ভোররাতে। বেবীও উঠে পড়ল। একটু পরই বুঝতে পারলাম মুহুর্মুহু গুলি হচ্ছে। জানালার কাচ ভেঙে পড়ছে। আমরা দু-বোন দৌড়ে আব্বা-মায়ের ঘরে চলে গেলাম। ভাই, ভাবি, বাচ্চারা, ছোট ভাই—যে যার ঘর থেকে চলে এল আব্বার ঘরে।
কিছুই বুঝতে পারছিলাম না আমরা। মা আব্বাকে বললেন মামার বাসায় টেলিফোন করতে। আব্বা টেলিফোনে বড় মামার সঙ্গে কথা বললেন। মা জিজ্ঞেস করতেই আব্বা গম্ভীরভাবে বললেন, তাঁরও আমাদের মতো অবস্থা। আমরা সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মা ভাবিকে বললেন মনি ভাইকে টেলিফোন করতে। মনি ভাই পরিস্থিতির বুঝে বললেন, ফোন রাখেন আমি দেখছি।
এরই মধ্যে কানে এল বুটের আওয়াজ। বুটগুলো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে। ওরা ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। সশস্ত্র, ১৫-২০ জন হবে। সবাইকে বলল নিচে নামতে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আব্বা ধরে ছিলেন আমার হাত।
আমাদের সবাইকে নিচে ড্রয়িং রুমে আনা হলো। আব্বাকে একজন নাম জিজ্ঞেস করল। আব্বা বললেন, আমার নাম আবদুর রব সেরনিয়াবাত। আগের দিন বরিশাল থেকে চার-পাঁচজন ছেলে এসেছিল। তাদেরও আনা হয়েছে ওই ঘরে। আব্বা সশস্ত্র লোকদের জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের কমান্ডিং অফিসার কে? একজন রাগান্বিত হয়ে বলল, আমাদের কোনো কমান্ডিং অফিসার নেই।
কথা শেষ হতে না হতেই মাত্র দু-হাত দূরত্বের মধ্য থেকে শুরু হলো ব্রাশফায়ার। তখনো আমার হাত ধরে ছিলেন আব্বা। এই প্রথমবার আমি চিত্কার করে জড়িয়ে ধরলাম আব্বাকে। আবার দ্বিতীয় রাউন্ড। মাটিতে পড়ে গেলাম। মনে হলো আব্বাও উপুড় হয়ে পড়লেন।
জ্ঞান ফিরলে চেয়ে দেখলাম আমি হাসপাতালে। শুনলাম মনি ভাই, আরজু আপা, বড় মামার বাসায় লোকজন—কেউ বেঁচে নেই। চিত্কার দিয়ে আবার জ্ঞান হারালাম। এভাবে অচেতন অবস্থায় কেটে গেল ১৪ দিন, পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে। যখন পুরোপুরি জ্ঞান ফিরল, চিকিৎসক বললেন, পাশের ওয়ার্ডে আমার মা, ভাবি ও ছোট বোন আহত অবস্থায় বেঁচে আছে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিনতলায় চক্ষু বিভাগের একটি ঘরে রাখা হলো আমাদের চারজনকে। আমাদের বাসার আর কেউ বেঁচে নেই। আস্তে আস্তে আমার কাছে সবকিছু স্পষ্ট হতে লাগল।
পরে জেনেছি, খুনিরা চলে গেলে আমাদের বাসার দুজন সিকিউরিটি গার্ড রমনা থানায় গিয়েছিলেন খবর দিতে। তত্কালীন ওসি অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই আমাদের তাঁর নিজস্ব পুলিশ ভ্যানে পাঠিয়েছিলেন হাসপাতালে।
ওই রাতে ঘাতকের বুলেটের আঘাতে আমাদের বাসায় প্রাণ হারিয়েছেন আমার বাবা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, চাচাতো ভাই সাংবাদিক শহিদ সেরনিয়াবাত, বোন বেবী সেরনিয়াবাত, ভাই আরিফ সেরনিয়াবাত, ভাইয়ের ছেলে সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত ও বরিশালের ক্রিডেন্স শিল্পগোষ্ঠীর সদস্য আবদুর নঈম খান রিন্টু। আর বাকি যারা ছিলাম আমরা, সবার নাম আহতের খাতায়।
হাসপাতালে প্রায় এক মাস পর মা, ভাবি, ছোট বোন রিনা কিছুটা সুস্থ। উঠে বসে সামান্য হাঁটাচলা করতে পারে। কিন্তু আমার সেই শক্তিটুকুও নেই। অনুভব করলাম, ডান পা অবশ হয়ে গেছে আমার, কোনো কাজ করছে না। চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে বললেন, গুলিতে ডান পায়ের কয়েকটি শিরা ছিঁড়ে গেছে।
পায়ে কয়েক দিন ফিজিওথেরাপি করার পর দেখা দিল নতুন উপসর্গ। শরীরে অসম্ভব যন্ত্রণা—জ্বালাপোড়া হতো সারাক্ষণ। দিন-রাত শুধু চিত্কার করি। মাঝেমধ্যেই আমাকে পেথিডিন দিয়ে অচেতন করে রাখা হয়। চিকিৎসকেরা বললেন, এটা বারুদের প্রতিক্রিয়া।
এভাবেই চলতে লাগল অনেক দিন। প্রায় তিন মাস ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুর্বিষহ দিন কাটিয়েছি। পরে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে চিকিৎসার জন্য গিয়েছি ভারতে।
আমার পরিবারের যাদের হারিয়েছি, যা হারিয়েছি, তা কি আর আর ফিরে পাব? না। এখনো শরীরে ১০টি বুলেটের আঘাত বহন করে ৪২ বছর আমি বয়ে বেড়াচ্ছি দুঃসহ স্মৃতির ভার। সেই রাতের করুণ কাহিনি মনে হলেই আজও নদী হয়ে যায় দুচোখ।
হামিদা সেরনিয়াবাত: আবদুর রব সেরনিয়াবাতের মেয়ে।
প্রথম আলো, ১৫ আগস্ট, ২০১৭