রিমালের ঝঞ্ঝা মোকাবিলা করে প্রসূতি ফাতেমার মুখে হাসি
ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডব চলছে। ২৭ মে সোমবার ভোরের দিকে বাগেরহাটের মোংলায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেওয়া ফাতেমা আক্তারের পরিবারের সদস্যরা দিশাহারা হয়ে পড়লেন। অন্তঃসত্ত্বা ফাতেমার পানি ভাঙা শুরু হয়েছে। তাঁকে হাসপাতালে নিতে হবে। একটি ইজিবাইক পাওয়া গেলেও পথে তা বন্ধ হয়ে গেল। পরিবারের সদস্যরা তা ঠেলে ঠেলে নিলেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে তাঁকে খুলনায় নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপর পরিবারটি আরও দুই জায়গায় গিয়েও ব্যর্থ হয়। নদী উত্তাল থাকায় খুলনায়ও যেতে পারছিলেন না। পরে তাঁরা আবার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ফিরে আসেন। সেখানে অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে ফাতেমা মেয়ের জন্ম দেন।
এখনো নবজাতকের নাম রাখা হয়নি। তবে ফাতেমা ও তাঁর স্বজনেরা বলেন, ঘূর্ণিঝড় মাথায় করে মেয়ের জন্ম হয়েছে। তাই মেয়ের নাম ঝড়ের নামেই রাখবেন।
এবারের ঘূর্ণিঝড় তো ভয়াবহ ছিল। এমন ভয়াবহ ঝড়ের নামে মেয়ের নাম রাখবেন জানতে চাইলে আজ বুধবার মুঠোফোনে ফাতেমা বলেন, ‘যতবার মেয়েরে নাম ধইরা ডাকমু, ততবার এই দিনটার কথা মনে পড়ব। এ হাসপাতাল, ও হাসপাতালে দৌড়াইতে দৌড়াইতে ক্লান্ত হইয়া পড়ছিলাম। ভাবছিলাম, আমি মনে হয় আর বাঁচমু না। ঝড়ের মধ্যে ডাক্তার ও সবাই সাহায্য করছিল বইল্যা মেয়ের মুখ দেখতে পারছি।’
২৬ মে রোববার রাত আটটার দিকে ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র মোংলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ উপকূল ও বাংলাদেশের পটুয়াখালীর খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম শুরু করে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলাসহ উপকূলের বিভিন্ন জেলায় ঝোড়ো হাওয়া ও ভারী বৃষ্টি হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় জলোচ্ছ্বাসও হয়। পরদিন সোমবারও ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সারা দেশে ঝড়–বৃষ্টি হয়।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি অস্ত্রোপচারের জন্য কতটুকু প্রস্তুত ছিল
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান হিসেবে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা চিকিৎসক মো. শাহীন হোসেন ফাতেমার অস্ত্রোপচারের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। তিনি তাঁর ফেসবুকে অস্ত্রোপচার কক্ষের ও ফাতেমার মেয়ের ছবি দিয়ে একটি পোস্ট শেয়ার করেছেন। শিরোনাম ‘ঘূর্ণিঝড় রিমাল এবং একটি ইমার্জেন্সি সিজার!’
মো. শাহীন হোসেন ফেসবুকে তাঁর লেখায় জানিয়েছেন, রিমালের প্রভাবে এলাকায় দুই দিন ধরে বিদ্যুৎ ছিল না। ঝড়ের রাতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সাইক্লোন সেন্টার থেকে হাসপাতালে একজন মাকে পাঠান। এই মায়ের (ফাতেমা) পানির পরিমাণ (এমনিওটিক ফ্লুইড) কমে যাচ্ছিল। কিন্তু স্বাভাবিক প্রসবের জন্য যে ব্যথা থাকা দরকার, তা ছিল না। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অস্ত্রোপচার কক্ষের (ওটি) মেরামতের কাজ চলমান থাকায় এই মাকে খুলনায় রেফার করা হয়। কিন্তু খুলনা যেতে না পেরে এলাকার আরেকটি হাসপাতাল ঘুরে এই রোগী আবার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন। পরে ইউএনও হাসপাতালে আসেন। সিদ্ধান্ত হয় অস্ত্রোপচারের। শাহীন হোসেন ইউএনও নিশাত তামান্না, অস্ত্রোপচারের সময় উপস্থিত চিকিৎসক ও অন্যদের নাম উল্লেখ করে ফেসবুক পোস্টে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকেরা জানান, জন্মের সময় ফাতেমার মেয়ের ওজন ছিল ৩ কেজি ৮০০ গ্রাম। ওটি থেকে মেরামতের জিনিস সরিয়ে তেল কিনে জেনারেটর চালু করে এরপর অস্ত্রোপচার করা হয়।
ফাতেমার অস্ত্রোপচার করেন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার চিকিৎসক আফসানা নাইমা হাসান। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে ফাতেমার অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। ওটি যেমন পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকা প্রয়োজন, সেই মুহূর্তে তা করা সম্ভব হয়নি। কোনোরকমে ওটি টেবিল ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ঠিকঠাকের পর জেনারেটর চালু করে অস্ত্রোপচার শেষ করতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের মাথায় ছিল যে করেই হোক মা ও নবজাতককে বাঁচাতে হবে।’
আফসানা নাইমা হাসান বলেন, ‘আমি কোয়ার্টারে ছিলাম। লোক পাঠিয়ে আমাকে খবর দেওয়া হয়। অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার জন্য রাব্বী ক্লিনিকের আবাসিক মেডিকেল অফিসার আবদুল্লাহ আল মামুনকে লোক পাঠিয়ে ডেকে আনতে হয়। এবারের ঘূর্ণিঝড়ের গতিপ্রকৃতি নিয়ে আমাদের মধ্যেও আতঙ্ক কাজ করছিল।’
ওটিতে অস্ত্রোপচারের সময় ছিলেন কমপ্লেক্সটির সহকারী সার্জন এম এ মোহাইমেন ইবনে মোস্তাফিজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ফাতেমা ভোরে যখন আসেন, তখন তাঁর পানি ভেঙে গেছে। কিন্তু জরায়ুর মুখ খুলছে না এবং ব্যথাও হচ্ছে না। বাচ্চা প্রসবে দেরি করলে বাচ্চার ক্ষতি হবে। অস্ত্রোপচার ছাড়া উপায়ও ছিল না। ঝুঁকি নিয়ে ফাতেমার অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। এখনো তাঁর ব্যথাসহ কিছু জটিলতা আছে। তাই তাঁকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সাত দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।
২৪ বছর বয়সী ফাতেমার এটি দ্বিতীয় সন্তান। আগের সন্তানের বয়স ছয় বছর। ফাতেমা মোংলার চিলা ইউনিয়নে তাঁর বাবার বাড়ি থেকে সাইক্লোন সেন্টারে যান। তাঁর সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ ছিল ৩ জুন। ফলে সন্তান প্রসবের জন্য সেভাবে প্রস্তুতি ছিল না ফাতেমার পরিবারের।
মোংলার ইউএনও নিশাত তামান্না প্রথম আলোকে বলেন, ফাতেমার জটিলতার কথা জানার পর তিনি দ্রুত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চলে আসেন। সেখানে চিকিৎসকদের সঙ্গে বসে যে করেই হোক অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত হয়। ফাতেমার ওষুধ কেনাসহ অন্যান্য খরচ বাবদ কিছু অর্থ পরিবারটিকে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে ইউএনও পরেও সহায়তার চেষ্টা থাকবে বলে আশ্বাস দেন।
ফাতেমার স্বামী বেলাল হোসেন অস্ত্রোপচারের দিন ফাতেমার সঙ্গে ছিলেন না। তিনি অন্য এলাকায় গাছ কাটার কাজ করেন। গতকাল মঙ্গলবার তিনি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসেছেন। সেখানে ফাতেমার সঙ্গে রয়েছেন শাশুড়ি সাইয়েদা বেগম। তাঁদের বাড়ি খুলনায় হলেও তাঁরা মোংলাতেই থাকেন।
সাইয়েদা বেগম বলেন, ‘ওই যে ঝড়ের যেন কী নাম—ওই রিমাল নাকি, সবাই এই ঝড়ের নামেই নাতনির নাম রাখতে বলতেছে। আমরাও ঠিক করছি এই নাম রাখার।’