‘অটিস্টিক মেয়েই আমাকে শক্তি ও সাহস জোগাচ্ছে’
বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস সামনে রেখে সৈয়দা মুনিরা ইসলাম শুনিয়েছেন তাঁর বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মেয়ে ফাবলিহা আজিমকে নিয়ে পথ চলার গল্প।
ফাবলিহা আজিমকে (অর্ণা) অনেক চেষ্টা করেও অক্ষর চেনানো যায়নি। নিজের নাম লিখতে পারেন না। তবে দেড় বছর ধরে অস্পষ্ট হলেও কথা বলতে পারছেন। পুঁতি দিয়ে মালা গাঁথতে পছন্দ করেন। চোখে আইলাইনার লাগাতে পারেন। বাবা, ভাই বা অন্যদের সামনে পোশাক পাল্টাতে হয় না, তা বুঝতে পারেন। শরীরে কোনটি খারাপ আর কোনটা ভালো স্পর্শ তা বুঝতে পারেন। জেদ করলেও এখন ফাবলিহাকে সামলানো যায়।
এভাবেই মেয়ে কী কী করতে পারে, বলছিলেন মা সৈয়দা মুনিরা ইসলাম। তিনি বলেন, মেয়ে কিছু করতে পারবে, এক সময় এটা কল্পনা করাটাও কঠিন ছিল।
সৈয়দা মুনিরা ইসলাম বলেন, ‘এই অটিস্টিক মেয়েই আমার বড় শক্তি। মেয়ের জন্যই নতুন করে বাঁচতে শিখেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে সম্মাননা পাওয়া বা আজকের আমি হয়ে উঠতে পেরেছি শুধু আমার মেয়ের জন্য।’
গত শনিবার রাতে কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে মা যখন মেয়েকে নিয়ে কথা বলছিলেন, তখন ফাবলিহা একটু পরপর বলছেন—আম্মু চলো, বাসায় যাব। ভাত খাব। ঘুমাব। আর মুনিরা নানা কথা বলে মেয়েকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলেন।
সৈয়দা মুনিরা ইসলাম বললেন, ‘একসময় মেয়েকে শান্ত রাখা কঠিন ছিল। সামনে যাকে পেত, তাকেই চিমটি দিয়ে চামড়া তুলে ফেলত অথবা কামড় দিয়ে মাংস তুলে ফেলত। এমন হলে মেয়েকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিতাম। একসময় তাঁর চিৎকার মাথায় ঢুকে যেত। সে যে কী যন্ত্রণা! তাঁর চিমটি আর কামড়ে শরীরে এমন দাগ হয়েছিল যে দীর্ঘ সময় আমাকে লম্বা হাতার জামা পরতে হতো।’
আজ মঙ্গলবার বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস উপলক্ষে আলাপ হলো সৈয়দা মুনিরা ইসলামের সঙ্গে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য—‘সচেতনতা-স্বীকৃতি-মূল্যায়ন: শুধু বেঁচে থাকা থেকে সমৃদ্ধির পথে যাত্রা’।
মুনিরা বললেন, সঠিক প্রশিক্ষণ ও পরিবার থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা পেলে বিশেষ চাহিদার বা অটিজম বৈশিষ্ট্যের মানুষও কতটা এগিয়ে যেতে পারে, ফাবলিহা তার প্রমাণ।
কঠিন সময় ফাবলিহাকে আজকের অবস্থায় আনতে সৈয়দা মুনিরা ইসলাম ও তাঁর পরিবারকে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে এবং হচ্ছে। মুনিরা বর্তমানে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান ‘হাত বাড়িয়ে দিলাম’-এর ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিভা বিকাশে ‘অদম্য সুর’ নামের একটি রিয়্যালিটি শো করছেন। ‘ইন্সপিরেশন ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন।
ফাবলিহার জন্ম ১৯৯৬ সালে। সৈয়দা মুনিরা ইসলাম জানান, চার বছর বয়স পর্যন্ত মেয়ের বিষয়ে কিছুই বুঝতেই পারেননি। তবে সে অন্য বাচ্চাদের মতো নয়, সেটি বুঝতেন। পুতুল খেলতে দিলে মেয়ে পুতুলের চুলের মুঠি ধরে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে টেনে নিয়ে যেত। লিখতে দিলে খাতা উল্টো করে ফেলত। চোখের দিকে তাকাত না, জেদ করত। খাবার দিলে নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নিত। টেলিভিশনে আজান দিলে দৌড়ে টেলিভিশনের কাছে গিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনত।
সৈয়দা মুনিরা ইসলাম বললেন, ‘আমি ভাবতাম, আমার মেয়ে কেন আমার কথা শুনবে না। তাকে বাধ্য করতে চাইতাম। পরে এক সময় জানলাম, তার অস্বাভাবিক বা অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণই তার জন্য স্বাভাবিক।’
চিকিৎসক যখন জানালেন, মেয়ে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বা অটিস্টিক শিশু, তখন সৈয়দা মুনিরা ইসলাম ও তাঁর স্বামী রাজউক কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. আজিমুল ইসলামের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
মুনিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে পাস করেছেন। মেয়ে অটিস্টিক যখন জানলেন, তখন তিনি নরওয়ের একটি প্রকল্পে কাজ করতেন। ওই প্রকল্পের মাধ্যমেই পিএইচডি করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
মুনিরা বললেন, ‘পিএইচডি করা আমার স্বপ্ন ছিল। তবে চিকিৎসক বলে দিয়েছেন, মেয়েকে প্রচুর সময় দিতে হবে। তাই চাকরি ছাড়লাম। পিএইচডি আর হলো না। ঘরবন্দী হয়ে গেলাম। মেয়ের চিন্তায় বিষণ্নতায় ডুবে গেলাম। তবে মেয়ের কথা চিন্তা করে সবকিছু মেনে নতুন করে জীবন শুরু করলাম।’
মুনিরা বলেন, ‘নতুনভাবে জীবন শুরু সহজ ছিল না। আমরা অনেক বছর খাবার টেবিলে একসঙ্গে খেতে পারিনি। মেয়ে হুট করে টেবিলের সব জিনিস ফেলে দিত। মেয়ের যদি খিঁচুনি হয়, এই ভয়ে আমরা বহু বছর ঢাকার বাইরে যাইনি। মেয়ে নিজেই দেয়ালে নিজের মাথা ঠুকে দিত। আমাদের পারিবারিক জীবন বলতে কিছু ছিল না।’
ফাবলিহার পাঁচ বছরের ছোট ভাই মো. ওমর রায়হান ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। মুনিরা বললেন, ‘ছেলেকে যথেষ্ট সময় দিতে পারিনি। ছেলেও বোনের জন্য সব মেনে নিয়েছে। বিষয়টি ছেলের দৈনন্দিন জীবনেও প্রভাব ফেলেছে।’
ফাবলিহা ছবি আঁকতে ও রং করতে পছন্দ করেন। তবে ছবিগুলো গতানুগতিক নয়। তাঁর মনের ভেতরের যে জগৎ, তা–ই হয়তো তিনি ছবিতে তুলে ধরেন, যা অন্যরা বুঝতে পারেন না।
ফাবলিহার ওষুধের জন্য মাসে বড় একটি বাজেট আলাদা করে রাখতে হয়। মুনিরা বলেন, অনেক পরিবারের এত অর্থ ব্যয়ের সামর্থ্য নেই। সরকারের ভাতাসহ নানান কার্যক্রম আছে। আইনও আছে; কিন্তু বাস্তবতা হলো, আইনের বাস্তবায়ন নেই। সরকারের সুযোগ-সুবিধা ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে পেতে অনেক সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
ফাবলিহার মাসিক শুরু হলে আরেক সংগ্রাম শুরু হয়। ফাবলিহা স্যানিটারি প্যাড পরতে চান না। মুনিরা বলেন, প্যাড পরিয়ে দিলে খুলে ফেলে। কুচিকুচি করে ঘরে ছড়িয়ে দেয়। আগে বাবার সঙ্গে ঘুমাত। বাবা বা ভাইকে জাপটে ধরত। তাকে বাবা ও ভাইকে দিয়ে বোঝানো হয়েছে, সবাইকে জাপটে ধরতে হয় না।
ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
মুনিরা জানান, ফাবলিহা ঘুরতে পছন্দ করে। আর মেয়ের এই পছন্দকে কাজে লাগিয়েই তিনি ঘরের চার দেয়ালের বাইরে যাওয়ার সাহস পেয়েছিলেন। তারপর থেকে সকালে মা–মেয়ে একসঙ্গে বের হন। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া বা প্রতিবেদনের কাজে বা কর্মস্থল—যেখানে যান, সঙ্গী হন মেয়ে। কাজ শেষ করে একসঙ্গেই বাড়ি ফেরেন তাঁরা।
মুনিরা বললেন, ‘আমরা কখনোই মেয়েকে লুকিয়ে রাখিনি। দাওয়াত বা যেকোনো উৎসবে মেয়েকে নিয়ে যাই। শুরুতে এ নিয়ে মানুষের বাজে কথাও শুনতে হয়েছে।’
টেলিভিশন চ্যানেলে ‘হাত বাড়িয়ে দিলাম’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মুনিরা কতশত পরিবারের গল্প মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন, তার হিসাব নেই। শুধু তাঁদের গল্প তুলে ধরেই তিনি দায়িত্ব শেষ করেননি। কখনো নিজ খরচে আবার কখনো অন্যের সহায়তায় পরিবারগুলোর পুনর্বাসনেও সহায়তা করছেন তিনি।
কাজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে মুনিরা বললেন, ‘বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে আমার মুঠোফোন নম্বর দেওয়া হয়েছিল। মাত্র সাত দিনে হাজার হাজার ফোন পেয়েছিলাম। সবার একই কথা—কোথায় প্রতিবন্ধী মানুষটির জন্য একটু সহায়তা পাওয়া যাবে? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, সন্তানের দায় মায়ের কাঁধে চাপিয়ে মাকে ছেড়ে চলে গেছেন বাবা। সব পরিবারের একটাই চিন্তা, মা–বাবা না থাকলে কে দেখবে সন্তানটিকে?’
হতাশার কথা বাদ দিয়ে মুনিরা আবার ফিরে গেলেন মেয়ের সাফল্যের গল্পে। তিনি জানান, ফেসবুকে মেয়ের নামে একটি গয়নার পেজ খুলেছেন। মেয়ে পুঁতি দিয়ে মালা বানাচ্ছে। সে মালার গিঁটটা দিতে পারে না। আমরা তো পারি। এভাবেই মেয়ের বানানো গয়নাসহ নানা গয়না দিয়ে পেজটি চলছে।
মুনিরা বলেন, ‘আমার মেয়ে মডেল হতে চায়। ফাবলিহাসহ প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের নিয়ে র্যাম্প শোর আয়োজন করি। দেশের বিখ্যাত মডেলদের সঙ্গে সন্তানকে র্যাম্পে হাঁটতে দেখে দর্শকসারিতে বসা বাবা–মায়েরা আনন্দে কাঁদতে থাকেন।’
প্রতিবন্ধী মানুষদের কেউ সম্মান দিতে চায় না। মুনিরা বলেন, ‘বাসায় যে কথা বলা ময়না পাখিটা আছে, তাকে তাঁর মেয়েকে “অর্ণা আপু” বলে ডাকতে শিখিয়েছি। মেয়েকে কেউ আপু ডাকছে, এটা সে খুব পছন্দ করে।’
মুনিরা বলে চলেন, ‘একসময় বুঝতে পারি, মেয়ের আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে। মেয়ের বন্ধু হতে হবে। মেয়ে কাগজ কাটছে, আমিও বসে কাগজ কাটতে থাকি। মেয়ের কোনো গান পছন্দ হলে হয় তো মাসের পর মাস সে একই গান শুনতে থাকে। আমরাও সেই গান শুনতে থাকি। আমি বা আমার পরিবার ছাড়া আমার মেয়ের কোনো বন্ধু নেই। তাই আমরাই ওর বন্ধু।’
সৈয়দা মুনিরা বলেন, ‘মেয়ের মতো এসব মানুষের জন্য একটি নিরাপদ পৃথিবী রেখে যেতে হবে। সে চেষ্টা শুধু প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পরিবার করলে হবে না, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যরা তাদের হাত ধরলেই তারা নিরাপদে বাঁচতে পারবে।’
ফাবলিহার চিকিৎসক অধ্যাপক গোলাম রব্বানী, টেলিভিশন চ্যানেল কর্তৃপক্ষসহ যেসব মানুষ ফাবলিহার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন সৈয়দা মুনিরা। তিনি বলেন, ‘আজকের আমি হয়েছি, শুধু আমার মেয়ের জন্য। অটিস্টিক মেয়েই আমাকে শক্তি ও সাহস জোগাচ্ছে। প্রতিবন্ধী মানেই প্রতিভাবন্ধী নয়—এই স্লোগান সামনে রেখেই আমরা মা–মেয়ে সামনে এগিয়ে চলছি। মেয়ের ছোট একটি অর্জনেও মনে হয় বিশ্ব জয় করে ফেলেছি।’