পদোন্নতি না পাওয়া ১০৫ উপসচিব যুগ্মসচিব হতে চান
বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মরত সরকারের ১০৫ জন উপসচিব নিজেদের ‘অন্যায়ভাবে পদোন্নতি বঞ্চিত’ বলে মনে করছেন। তাই তাঁরা জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী নিয়মিত ব্যাচের সঙ্গে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির দাবি জানিয়ে গত সোমবার জনপ্রশাসন সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরীর কাছে আবেদন করেছেন। আবেদনের অনুলিপি গেছে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, অর্থসচিব, জননিরাপত্তা সচিব ও আইনসচিবের কাছে।
আবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর ও সংস্থায় নিযুক্ত থেকে তাঁরা সততা, সুনাম ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে আসছেন। কিন্তু পদোন্নতির সব যোগ্যতা ও শর্ত পরিপালন করা সত্ত্বেও যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি না দিয়ে তাঁদের ন্যায়সংগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
বলা হয়েছে, প্রশাসন ক্যাডারের যে ব্যাচের কর্মকর্তারা উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব হয়েছেন, তার আগে অথবা একই সময়ে পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করলেও দুঃখজনকভাবে তাঁদের পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। অথচ জুনিয়র ব্যাচের অনেকে যুগ্ম সচিব হয়েছেন। পদোন্নতি দেওয়া হয়নি ১০৫ জনকে। জুনিয়রদের অধীনে কাজ করতে বাধ্য করে তাঁদের মানসিক, শারীরিক, আর্থিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতির মধ্যে ফেলা হয়েছে।
গত ৪ সেপ্টেম্বর মোট ২২১ জন উপসচিবকে পদোন্নতি দিয়ে যুগ্ম সচিব করা হয়। এর মধ্যে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২২তম ব্যাচের ১৮০ জন রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারে একীভূত হওয়া ২২তম ব্যাচের ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তারাও রয়েছেন। অথচ প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্য ক্যাডারের ১৩তম থেকে ২২তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের সব ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি দেওয়া হয়নি।
আবেদনে বলা হয়েছে, পদোন্নতির ভিত্তি হবে মেধা, দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতা। আর বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) সুপারিশ করা একটি ব্যাচের সম্মিলিত তালিকাই হবে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তি। তা অনুসরণ না করে সরকার যা করেছে, তা শুধু সংবিধানের লঙ্ঘন নয়, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়েরও লঙ্ঘন। এ ছাড়া এ ঘটনার মাধ্যমে জ্যেষ্ঠতা হরণ ও ক্যাডার বিভাজন করা হয়েছে। উপসচিব হলেই কর্মকর্তাদের আগের কোনো ক্যাডার পরিচিতি থাকবে না এবং সব উপসচিবই সমঅধিকার ও সমমর্যাদাসম্পন্ন হবেন—এটাই হচ্ছে বিদ্যমান ১৯৮৩ সালের সিভিল সার্ভিস জ্যেষ্ঠতা বিধিমালার নিয়ম। পদোন্নতির সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষ পর্যায়ের যেসব কর্মকর্তা জড়িত থাকেন, তাঁরা তা জানেনও।
আবেদনে আরও বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০০৩ সালে এক রায়ে বলেছেন, ‘যখনই কোনো কর্মকর্তা ২০০২ সালের বিধিমালা অনুযায়ী উপসচিব পদে পদোন্নতি পেলেন, তা যেকোনো ক্যাডার থেকেই হোক না কেন, তিনি তখন একজন পরিপূর্ণ উপসচিব। তাঁর আগের ক্যাডার পরিচয় তখন বিলুপ্ত হবে। অন্য সব উপসচিবের সঙ্গে একই শ্রেণিভুক্ত হয়ে এবং সমঅধিকার নিয়ে তিনি পরের উচ্চতর যুগ্ম সচিব পদে বা তারও পরে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়ার জন্য বিবেচিত হবেন।’
এ ছাড়া সরকারের উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতি বিধিমালা, ২০০২ অনুযায়ী যেসব শর্ত প্রতিপালন সাপেক্ষে প্রত্যেকে নিয়মিত ব্যাচের সঙ্গে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হবেন, সেগুলোর একটি হচ্ছে উপসচিব পদে অন্যূন পাঁচ বছর চাকরিসহ সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের সদস্য হিসেবে কমপক্ষে ১৫ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা। ‘অথবা’ দিয়ে অন্যটির কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, উপসচিব পদে অন্যূন তিন বছর চাকরিসহ ক্যাডার পদে ২০ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা। আবেদনে এসব উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, সে হিসাবে নিজ নিজ ব্যাচের সঙ্গে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করায় ১০৫ জনেরই পদোন্নতি প্রাপ্য।
এই ১০৫ জনের আবেদনের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল জনপ্রশাসন সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরীর কাছে। তিনি গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেকে আগে আলাদা আবেদন করেছেন। ১০৫ জনের আবেদনটি এখনো আমার নজরে পড়েনি। অফিসে খোঁজ নিয়ে তা দেখব এবং পরে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।’
কী হয়েছিল ৪ সেপ্টেম্বর
গত ৪ সেপ্টেম্বর ২২১ জন উপসচিবকে যুগ্ম সচিব করা হয়, যার মধ্যে ১৯৭ জনই প্রশাসন ক্যাডারের। এঁদের মধ্যে ১৮০ জন কর্মকর্তাই ২২তম ব্যাচের। প্রশাসন ছাড়া ২২তম ব্যাচের অন্য কোনো ক্যাডারের কেউই পদোন্নতি পাননি। পদোন্নতি না পাওয়া কর্মকর্তারা বলছেন, ইকোনমিক ক্যাডারের মতো জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী নিয়মিত ব্যাচের সঙ্গে ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব হওয়া তাঁদের অধিকার।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯ সালের জুন থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয়বার উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রশাসন ছাড়া অন্য ক্যাডার থেকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি হয়েছে ১০ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
অথচ প্রশাসন ছাড়া অন্য ক্যাডার থেকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতিতে ২০২২ সালের নভেম্বরে ১৭ শতাংশ, একই বছরের জুনে ২১ শতাংশ, ২০২১ সালের অক্টোবরে ১৫ শতাংশ, ২০২০ সালের জুনে ২৫ শতাংশ এবং ২০১৯ সালের জুনে ছিল ২২ শতাংশ।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসনবিষয়ক অনেক বইয়ের লেখক ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, যোগ্যতা ও দক্ষতা যাচাই করে যদি পদোন্নতি দেওয়া হতো, তাহলে কারও বঞ্চিত হওয়ার প্রশ্ন উঠত না। এটা ঠিক, পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে।
অনেক কর্মকর্তাকে জুনিয়রদের অধীনে কাজ করতে হচ্ছে—এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘এটা যে কতটা বেদনাদায়ক, ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউই তা বুঝবেন না।’