বিষধর রাসেলস ভাইপারের সংখ্যা বাড়ছে, বদলাচ্ছে স্বাভাবিক চরিত্র

রাসেলস ভাইপারের কামড়ে গত মাসে মারা যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী শাকিনুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপের আরেক নাম উলুবোড়া। বিষধর এ সাপ মাঝে কয়েক বছর খুব কম দেখা গেছে। তবে কয়েক বছর ধরে এর বিচরণ আবার বাড়ছে। আবার সাপটি এর স্বাভাবিক চরিত্রও বদলাচ্ছে।

গত এক মাসেই রাজশাহীর চারঘাট, গোদাগাড়ী, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ, চাঁদপুরের মতলবসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় দেখা পাওয়া গেছে রাসেলস ভাইপারের। গত তিন মাসে পদ্মার তীরবর্তী মানিকগঞ্জে অন্তত পাঁচজন প্রাণ হারিয়েছেন এ সাপের দংশনে। বিষধর এ সাপ নিয়ে দেশে এখন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাপের এখন প্রজননকাল চলছে, তাই দেখাও যাচ্ছে বেশি। তবে রাসেলস ভাইপারের অভিযোজন ক্ষমতাও বেড়েছে। আসন্ন বর্ষাকালে পদ্মার অববাহিকা ধরে সাপের যাতায়াত আরও সহজ হবে। তাই সামনে রাসেলস ভাইপারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়। সাপটি দংশনের সময় সর্বোচ্চ পরিমাণে বিষ ঢেলে দেয়। তাই দ্রুততম সময়ে চিকিৎসা নিতে না পারলে প্রাণহানির ঝুঁকি বাড়ে।

রাসেলস ভাইপারের প্রজননকাল বছরের যেকোনো সময়ই। তবে মে থেকে পরের তিন মাস প্রজনন সবচেয়ে বেশি ঘটে। সাপটি এখন পানিতে চলতে পারে বলে বর্ষাকালে কচুরিপানার সঙ্গে বহুদূর পর্যন্ত ভেসে নিজের স্থানান্তর ঘটাতে পারে।
-ফরিদ আহসান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক

দেশে প্রায় ১০৪ প্রজাতির সাপ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৩০ প্রজাতির সাপ বিষধর। সবচেয়ে বিষধর হলো রাসেলস ভাইপার। চট্টগ্রামের ভেনম রিসার্চ সেন্টার তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে, শুধু বাংলাদেশ নয়, ভীষণ রকমের বিষাক্ত রাসেলস ভাইপার আছে ভারত, ভুটান, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, চীন ও মিয়ানমারে। এ সাপ সাধারণত ঘাস, ঝোপ, বন, ম্যানগ্রোভ ও ফসলের খেতে বাস করে।

দেশে কয়েক বছর ধরে রাসেলস ভাইপারের বিচরণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে গাজীপুরের শেখ কামাল ওয়াইল্ড লাইফ সেন্টারের সরীসৃপ-সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, রাসেলস ভাইপার বরেন্দ্র অঞ্চলের সাপ বলেই পরিচিত ছিল। এটি মূলত শুষ্ক জায়গার সাপ। বরেন্দ্র অঞ্চলে এক ফসলি মাঠে ইঁদুর খেতে এর আনাগোনা ছিল বেশি। তবে এখন সেসব এলাকায় অন্য সময়েও ফসল হচ্ছে, ইঁদুর বাড়ছে।

এ প্রাকৃতিক চক্রে রাসেলস ভাইপারের সংখ্যা বাড়ছে জানিয়ে সোহেল রানা বলেন, প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা বেড়েছে রাসেলস ভাইপারের। ফলে শুষ্ক অঞ্চল থেকে কচুরিপানার মতো যেকোনো ভাসমান কিছুর সঙ্গে ভেসে এটি নদীর ভাটির দিকে চলে যেতে পারছে। মূলত পদ্মা অববাহিকা ধরে এর সংখ্যা বাড়লেও দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জেলায় রাসেলস ভাইপারের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। হাতিয়া, ভোলায়ও এই সাপ দেখা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাপের এখন প্রজননকাল চলছে। তাই দেখাও যাচ্ছে বেশি। তবে রাসেলস ভাইপারের অভিযোজন ক্ষমতাও বেড়েছে। আসন্ন বর্ষাকালে পদ্মার অববাহিকা ধরে সাপের যাতায়াত আরও সহজ হবে। তাই সামনে রাসেলস ভাইপারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়।

সোহেল রানা প্রথম আলোকে আরও বলেন, এই সাপ যেহেতু ডিম না দিয়ে সন্তান প্রসব করে, ফলে সাপের বাচ্চাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে। রাসেলস ভাইপার সাধারণত ফোঁস ফোঁস শব্দ বেশি করে। অন্য সাপ মানুষকে দংশনের পর সেখান থেকে দ্রুত সরে যায়, কিন্তু রাসেলস ভাইপার ঘটনাস্থল থেকে সরতে চায় না।

রাসেলস ভাইপার স্থলভাগের সাপ হলেও এটিকে পানিতে দ্রুতগতিতে চলতে দেখেছেন বলে জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহসান। তিনি বলেন, অর্থাৎ এটি মাটি ও পানি উভয় স্থানে এখন স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে। প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখছে রাসেলস ভাইপার।

আরও পড়ুন

‘রাসেলস ভাইপারের পুনরাবির্ভাব ও মানুষের ঝুঁকি’ বিষয়ে গবেষণা করছেন অধ্যাপক ফরিদ আহসান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এই সাপের প্রজননকাল বছরের যেকোনো সময়ই। তবে মে থেকে পরের তিন মাস প্রজনন সবচেয়ে বেশি ঘটে। সাপটি এখন পানিতে চলতে পারে বলে বর্ষাকালে কচুরিপানার সঙ্গে বহুদূর পর্যন্ত ভেসে নিজের স্থানান্তর ঘটাতে পারে।

অধ্যাপক ফরিদ আহসান বলেন, আশির দশকেও সাপটি ছিল বাংলাদেশে। তবে তখন গবেষণা হতো না বলে মানুষের জানাশোনা ছিল কম। তবে এখন চরাঞ্চল বা নদীর তীরবর্তী মানুষকে বেশি সতর্ক থাকতে হবে।

রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ। ছবিটি ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারিতে তোলা। এটি ভোলার সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের একটি সবজিখেত থেকে উদ্ধারের পর চর কুকরিমুকরি বনে অবমুক্ত করা হয়েছিল
সংগৃহীত

প্রাণহানি ও সচেতনতা কার্যক্রম

মার্চ থেকে মে এই তিন মাসে মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের চরাঞ্চলেই বিষধর রাসেলস ভাইপারের দংশনে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত পাঁচজন।

এ ছাড়া গত মাসে এক দিনের ব্যবধানে রাজশাহীতে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ দুজন মারা যান। এ ঘটনায় আতঙ্ক দেখা দেয়। ধান কাটতে গিয়ে এক শ্রমিকের মৃত্যুর পর ধানকাটার শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায় বেশি। রাসেলস ভাইপারের কামড়ে মারা যাওয়া শিক্ষার্থী শাকিনুর রহমানের বাড়ি চারঘাটে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন

৩ জুন ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চলতি বছর এ পর্যন্ত পদ্মার তীরবর্তী রাজশাহী, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় রাসেলস ভাইপারের দংশনে অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

হরিরামপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহরিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তিনটি ইউনিয়ন আজিমনগর, সুতালড়ি ও লেছড়াগঞ্জ পদ্মা নদীর মধ্যবর্তী এলাকা হওয়ায় এসব স্থানে সাপের উপদ্রব বেশি। এখান থেকে মানিকগঞ্জ সদরে যেতে অন্তত তিন ঘণ্টা সময় লাগে, যা সাপের দংশনের রোগীর জীবনঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়। এ জন্য এলাকায় মাইকিং করে সচেতনতা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

ইউএনও বলেন, পায়ে বুট পরে ফসলের মাঠে যেতে কৃষকদের অনুরোধ করা হচ্ছে। মানুষকে সচেতন করতে মুঠোফোনে ‘সর্প দংশনে সচেতনতা’ নামে একটি অ্যাপস রয়েছে।

আরও পড়ুন

গত কয়েক বছরে রাসেলস ভাইপারের দংশনের খবর বাড়ছে। সেই সঙ্গে এ সাপের অবমুক্তকরণও বাড়ছে। অধ্যাপক ফরিদ আহসান জানান, অধিকাংশ রাসেলস ভাইপার অবমুক্ত করা হয় পদ্মা নদীর ওপারে নিরাপদ জায়গাতেই। এতে ঝুঁকি কম বলে মনে করেন তিনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার (এনসিডিসি) ২০২৩ সালের এক গবেষণা বলছে, দেশে প্রতিবছর প্রায় ৪ লাখ ৩ হাজার মানুষ সাপের দংশনের শিকার হন। এর মধ্যে সাড়ে ৭ হাজার মানুষ মারা যান। এ ছাড়া সাপের কামড়ে আক্রান্ত রোগীদের ১০ দশমিক ৬ শতাংশ শারীরিক ও ১ দশমিক ৯ শতাংশ মানসিক অক্ষমতায় ভোগেন।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন