কুয়েতে বাবার মৃত্যু কীভাবে, ১৪ বছর ধরে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন সেলিম

মো. আবদুল আলী
ছবি: সংগৃহীত

কুয়েতে কর্মরত অবস্থায় বাংলাদেশি মো. আবদুল আলীর মৃত্যুর কারণ জানতে ছেলে সেলিম ১৪ বছর ধরে বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরছেন। কিন্তু এখনো পাননি স্পষ্ট কোনো উত্তর। বর্তমানে ৪০ বছর বয়সী সেলিম বললেন, ‘বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরতে ঘুরতে আমি এখন ক্লান্ত। আমার বাবার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, এটা মানতে পারছি না। বাবার মৃত্যুর কারণ জানতে চাই। বাবাকে হত্যা করা হয়ে থাকলে যথাযথ ক্ষতিপূরণ চাই।’

গত রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) কারওয়ানবাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে কথাগুলো বলছিলেন সেলিম। তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন কুয়েতপ্রবাসী তাঁর চাচা আবদুল মান্নানও। সেলিম নারায়ণগঞ্জ আদালতে একজন আইনজীবীর সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। মা কাওসারী বেগমের বয়স হয়েছে। তিনিও একসময় ছেলের সঙ্গে বিভিন্ন দপ্তরে দৌড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।

২০১০ সালের ২৭ নভেম্বর কুয়েতের গিলিব আল সুয়েখ অঞ্চলে মৃত্যু হয় আবদুল আলীর। ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি আবদুল আলী লাশ হয়ে দেশে ফেরেন। আবদুল আলী ১৯৮৫ সাল থেকে দেশটিতে গাড়িচালক হিসেবে কাজ করছিলেন। দুই বা তিন বছর পরপর দেশে আসতেন। মারা যাওয়ার মাত্র দুই মাস আগে নতুন মালিকের অধীনে কাজ নিয়েছিলেন। তবে তিনি যে নিয়োগকর্তার মাধ্যমে দেশটিতে গিয়েছিলেন, তাঁর অধীনে কাজ না করে অন্য মালিকের অধীনে কাজ করছিলেন।

আবদুল আলীর মাথায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। তাঁর অনেকগুলো দাঁত ভাঙা ছিল। দাড়িতে রক্তের দাগ লেগে ছিল।

আবদুল আলীর ছোট ভাই আবদুল মান্নান কুয়েতে আছেন ৩৪ বছর ধরে। আবদুল আলী মারা যাওয়ার পর দেশে লাশ আনাসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন এ ভাই। ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর কুয়েতের জাতীয় দৈনিক আল শাহিদে আবদুল আলীর অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, আবদুল আলী মারা যাওয়ার আগে যে দুই মাস কাজ করেছিলেন, সেই দুই মাসের বেতনও পাননি। আবদুল মান্নান বর্তমানে ছুটিতে দেশে এসেছেন।

আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে জানালেন, প্রথমে তিনি মুঠোফোনে তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পান। এরপর যখন ভাইয়ের লাশ দেখেন, তখন আবদুল আলীর মাথায় আঘাতের চিহ্ন দেখেছিলেন। তাঁর অনেকগুলো দাঁত ভাঙা ছিল। দাড়িতে রক্তের দাগ লেগে ছিল। এসব দেখে তাঁর মনে হয় আবদুল আলীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি, তাঁকে কোনো কারণে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল।

ভাইয়ের মৃত্যু নিয়ে বেশ কিছু সংশয় আছে আবদুল মান্নানের মনে। তিনি বলেন, ভাইয়ের মৃত্যুর পর লাশ নিয়ে তড়িঘড়ি করছিলেন সংশ্লিষ্টরা। সেখানেই তাঁকে দাফনের কথা বলা হয়েছিল। তবে তাঁর মন সায় দেয়নি। মৃত্যুর কারণ জানার জন্য বা মামলা করবেন কি না, এসব নিয়েও ভাবছিলেন। কিন্তু তখন মোবাইলে বিভিন্ন জায়গা থেকে হুমকি পেতে থাকেন। এমনকি তাঁকে কোনো মামলা দিয়ে ফাঁসানো হতে পারে, এমন ইঙ্গিতও পেয়েছিলেন। দূতাবাসে তখন যাঁরা কর্মরত ছিলেন, তাঁদের কাছ থেকেও সহায়তা পাননি বলে অভিযোগ করলেন আবদুল মান্নান।

বাবার মৃত্যুর কারণটা জানতে না পারলে সারা জীবনের একটা আক্ষেপ থেকে যাবে।
সেলিম

২০১১ সালের ৭ আগস্ট কুয়েতের বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) কে এম আলী রেজা জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক বরাবর এক চিঠিতে উল্লেখ করেন, দূতাবাসের পক্ষ থেকে আবদুল আলীর মৃত্যুর কারণে ক্ষতিপূরণ/আর্থিক সুবিধা পাওয়া যায় কি না, সে বিষয়ে তাঁর কফিলের (নিয়োগকর্তা) মোবাইল নম্বরে (৯৯০৫৬২৩১) একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়েছে। কফিল ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কোনো ধরনের সহযোগিতা করতে পারবেন না বলে দূতাবাসকে জানিয়েছেন। আবদুল আলী কুয়েতে বৈধভাবে কর্মরত ছিলেন, চিঠিতে তা–ও উল্লেখ করা হয়েছে।

সেলিম
ছবি: মানসুরা হোসাইন

তবে সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, কফিলের নম্বর বলে চিঠিতে যে নম্বরটি দেওয়া হয়েছে, তা কুয়েতে থাকা তাঁর চাচা আবদুল মান্নানের নম্বর। ফলে দূতাবাস কফিলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এটার সত্যতা নিয়েই তো প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। এ ছাড়া তাঁর বাবার লাশ দেশে ফেরার পর তিনিও মাথায় আঘাতের চিহ্ন এবং দাঁত ভাঙা দেখেছিলেন। সে সময় তিনি তাঁর বাবার লাশের কোনো ছবি তুলে রাখেননি বলেও আফসোসের কথা জানালেন।

১১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক বরাবর আবার নতুন করে বাবার মৃত্যুর কারণ জানতে চেয়ে আবেদন করেছেন সেলিম। জানালেন, তাঁর বাবার লাশ দেশে ফেরার পর থেকে তিনি এ পর্যন্ত ১১টির বেশি এমন আবেদন করেছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে। সেলিম তাঁর সঙ্গে একটি প্লাস্টিকের ফাইলে বিভিন্ন সময়ে করা আবেদনগুলো দেখালেন।

মৃত আবদুল আলীর পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে। এত বছর পর আবদুল আলী কুয়েতে খুন হয়েছেন, তা প্রমাণ করা কঠিন।
মোস্তফা জামিল খান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার এবং ওয়েলফেয়ার অনুবিভাগের পরিচালক (ওয়েলফেয়ার)

গত ১৫ জানুয়ারি কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত বরাবর আবেদন করেন সেলিম। আবেদনে সেলিম লিখেছেন, তাঁর বাবার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। তবে কুয়েত থেকে মৃত্যুসনদ দেওয়া হয়েছে, সেখানে মৃত্যুর সঠিক কারণ উল্লেখ নেই। ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে কুয়েতের জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন শাখার মৃত্যুসনদে মৃত্যুর কারণের জায়গায় ‘অবস্থা বিবেচনাধীন’ লিখে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর আগে মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত ও সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণের দাবিতে গত ৫ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় বরাবর পুনরায় অভিযোগ জানিয়েছেন সেলিম। ২০১১ সাল থেকে এভাবেই একের পর এক আবেদন করেই যাচ্ছেন সেলিম।

সেলিম বলেন, তাঁর বাবার মোবাইলে কফিলের দুটি নম্বর ছিল। এ দুটি নম্বরে যোগাযোগ করলেও ঘটনার সত্যতা মিলত। তবে দূতাবাস থেকে কিছুই করা হয়নি।

২০১২ সালের ২৭ জুন জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো থেকে কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসকে ঘটনাটির পুনঃ তদন্তের অনুরোধ জানানো হয়। ওই বছরের ৭ আগস্ট কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) কে এম আলী রেজার পক্ষ থেকে উত্তর পাঠানো হয়। কিন্তু সেই উত্তরে সন্তুষ্ট না হওয়ায় আবদুল আলীর স্ত্রী কাওসারী বেগম ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল বিএমইটির পরিচালক (কল্যাণ) বরাবর পুনরায় আবেদন করেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার এবং ওয়েলফেয়ার অনুবিভাগের পরিচালক (ওয়েলফেয়ার) মোস্তফা জামিল খান গত ৬ ফেব্রুয়ারি লিখিতভাবে কুয়েত দূতাবাসকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মৃত আবদুল আলীর পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে। এত বছর পর আবদুল আলী কুয়েতে খুন হয়েছেন, তা প্রমাণ করা কঠিন।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের উপসহকারী পরিচালক কুয়েত ডেস্কের দায়িত্বে আছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভুক্তভোগী পরিবার বারবার আবেদন করছে। দূতাবাসের উত্তরে সন্তুষ্ট না হয়ে পুনরায় আবেদন করছে। আমরা এ আবেদন দূতাবাসসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জায়গায় পাঠাচ্ছি। তবে বিষয়টির এখনো সুরাহা হয়নি।’

কুয়েত থেকে বাবার পাঠানো টাকায় নারায়ণগঞ্জে তিন কাঠা জমিতে একটি তিনতলা বাড়ি করা হয়েছিল। সেখানেই মা, স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে থাকেন সেলিম।

সেলিম বললেন, ‘বাবার মৃত্যুর কারণটা জানতে না পারলে সারা জীবনের একটা আক্ষেপ থেকে যাবে। তাই সুষ্ঠু তদন্তের দাবি করেই যাচ্ছি। বাবাকে খুন করা হয়ে থাকলে ওই দেশের আইন অনুযায়ী কিসাস–এর বদলে কিসাস অথবা ক্ষতিপূরণ চাই।’