দেশে দ্রুত হারে বাড়ছে অস্ত্রোপচারে শিশুর জন্ম। ১৪ বছরে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশুর জন্ম (সিজারিয়ান সেকশন বা সি–সেকশন) বেড়েছে ৮ গুণের বেশি। এর মধ্যে বেশির ভাগ সি–সেকশন হচ্ছে অপ্রয়োজনীয়। হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রসবে যা খরচ হচ্ছে, তার চেয়ে চার গুণ বেশি খরচ হচ্ছে সি–সেকশনে।
আজ বুধবার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) সি–সেকশন নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরে এ তথ্য জানায়। সি–সেকশনের উচ্চ হার কমিয়ে আনতে জাতীয় পর্যায়ে যথাযথ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা নেওয়া ও বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।
‘ম্যাসিভ বুম অব সি–সেকশন ডেলিভারি ইন বাংলাদেশ: এ হাউসহোল্ড লেভেল অ্যানালাইসিস (২০০৪–২০১৮)’ (বাংলাদেশে সি–সেকশনের ব্যাপক বৃদ্ধি: পরিবার পর্যায়ে বিশ্লেষণ) শিরোনামে প্রতিবেদনটি সরাসরি বিআইডিএসের সম্মেলনকক্ষ ও অনলাইনে প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের (বিডিএইচএস) ২০০৩–২০০৪ থেকে সর্বশেষ ২০১৭–১৮–এর পাঁচটি জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা অনুযায়ী, একটি দেশে মোট শিশু জন্মের ১৫ শতাংশের বেশি সি–সেকশন হওয়া উচিত নয়। দেশে ২০০৪ সালে সি–সেকশন প্রায় ৪ শতাংশ ছিল। ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ শতাংশের বেশি। গ্রামের চেয়ে শহরের নারীদের বেশি সি–সেকশন হচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এ প্রবণতা বেশি। মা–বাবার শিক্ষা, আর্থিক সচ্ছলতা, প্রথম গর্ভধারণের বয়স, প্রসব–পূর্ব সময়ে (এএনসি) কতটা সেবা নিয়েছেন এবং মায়ের ওজনের ওপর সি–সেকশনের হার বাড়ছে। দেশে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবসেবা নেওয়ার হার ৫০ শতাংশ।
প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের গবেষণা ফেলো আবদুর রাজ্জাক সরকার। প্রতিবেদনে বলা হয়, হাসপাতালে প্রসব বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব বাড়ার সঙ্গে সি–সেকশনের হার পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এক জরিপে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে অপ্রয়োজনীয় সি–সেকশন হয়েছে ৮ লাখ ৬০ হাজার। প্রতি ১০টি সি–সেকশনের মধ্যে অন্তত ছয়টি অপ্রয়োজনীয় ছিল। সি–সেকশন বাড়ার ফলে অনেক পরিবারকে গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। বাড়িতে স্বাভাবিক প্রসবে ১ হাজার ৩০০ টাকা, প্রাতিষ্ঠানিক স্বাভাবিক প্রসবে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার বেশি এবং সি–সেকশনে ২০ হাজার টাকার বেশি খরচ হচ্ছে।
বিডিএইচএস ২০১৭–১৮ প্রতিবেদন অনুসারে, শহরের ৪৪ শতাংশ এবং গ্রামে ২৯ শতাংশ মায়ের সি–সেকশন হচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালে প্রসবের ৫২ শতাংশ এবং সরকারি হাসপাতালে ১১ শতাংশ সি–সেকশন হচ্ছে। ২০ বছরের নিচের বয়সী থেকে ৪৯ বছর বয়সী পর্যন্ত সব বয়সী নারীদের মধ্যে সি–সেকশনের হার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশের মধ্যে। সি–সেকশনে সন্তান জন্ম দিয়েছেন এমন মায়েদের প্রায় ৬০ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যায়ের বেশি পড়াশোনা জানা। ৩০ থেকে ৩৯ বছর বয়সী ৮৫ শতাংশ মা প্রথম সন্তান জন্ম দিয়েছেন সি–সেকশনের মাধ্যমে। এ ছাড়া অতিরিক্ত ওজনের মায়েদের প্রায় ৫৯ শতাংশ সি–সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিচ্ছেন।
অনুষ্ঠানে প্রশ্নোত্তর–পর্বে উঠে আসে অন্তঃসত্ত্বা মা নিজে এবং তাঁর পরিবার স্বাভাবিক প্রসবের দীর্ঘ ও কষ্টকর সময় পার করার ধৈর্য রাখেন না এমন মন্তব্য। কেউ কেউ বলেছেন, চিকিৎসকেরাও একজনের পেছনে এত সময় দিতে রাজি থাকেন না। তা ছাড়া অস্ত্রোপচারে অর্থ বেশি পাওয়ার বিষয় আছে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন। তিনি বলেন, যখন প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব কম হতো, তখন সি–সেকশনের হার কম ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন সি–সেকশন বাড়ছে, এ নিয়ে উন্নয়ন ইস্যু নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের আরও বিশ্লেষণ করা দরকার। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চেয়ে বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সি–সেকশন বেশি হওয়ার কারণ কী, সেটাও দেখা দরকার।
অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হয়ে অধ্যাপক আবদুস সাত্তার মন্ডল বলেন, সি–সেকশন বাড়ার ক্ষেত্রে একতরফা চিকিৎসকদের দোষ দিলে হবে না। অনেক অন্তঃসত্ত্বা মা, পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে স্বামী অস্থির হয়ে যান, তাঁরা স্বাভাবিক প্রসবের জন্য অপেক্ষা করাকে ঝুঁকি মনে করেন। তাঁরা সি–সেকশন বেছে নেন। গ্রামে সামাজিক মর্যাদা থেকেও সি–সেকশন বেছে নেওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়।
অনলাইনে যুক্ত হয়ে নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন হক বলেন, গ্রামেও সি–সেকশন বেড়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে চিকিৎসকদের চাপে পড়েই পরিবারগুলো সি–সেকশনের সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তদের সংখ্যা বেশি। তিনি বলেন, দাতা সংস্থাগুলোর চাপে সরকার শতভাগ প্রাতিষ্ঠানিক সেবার লক্ষ্য নিয়েছে। এটা করতে গিয়ে প্রশিক্ষিত ধাইদের বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে। প্রশিক্ষিত ধাইরা অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের ধরন দেখেই বুঝতে পারতেন, কোনটি হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে এবং কোনটি প্রসব করানো তাঁর সামর্থ্যের মধ্যে। তাই শতভাগ প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব যত দিন নিশ্চিত না হবে, তত দিন পর্যন্ত প্রশিক্ষিত দক্ষ ধাই গড়ে তুলতে হবে।