জলবায়ু সম্মেলনে কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি, হতাশা

  • আজ আনুষ্ঠানিক বাকু ঘোষণা।

  • বিশ্বের সব দেশের সম্মতির ভিত্তিতে ঘোষণা আসবে কি না, তা নিয়ে সংশয়।

জলবায়ু সম্মেলনের বর্ধিত সময় গতকালও পক্ষগুলোর মধ্যে শেষ মুহূর্তের দর-কষাকষি হয়। এ সময় দাবিদাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ করেন অধিকারকর্মীরা। গতকাল আজারবাইজানের বাকুতেছবি: রয়টার্স

বাকু জলবায়ু সম্মেলনের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ফাইন্যান্স কপ’ বা ‘জলবায়ুর আর্থিক সম্মেলন’। কিন্তু ২০০টি দেশের প্রতিনিধিরা দুই সপ্তাহ বৈঠক করেও কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেননি। গত শুক্রবার থেকে টানা দুই দিনের রুদ্ধদ্বার বৈঠকেও আসেনি কাঙ্ক্ষিত ফল।

বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি পোষাতে বছরে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন (১ লাখ ৩০ হাজার কোটি) ডলার চেয়েছে। আর শিল্পোন্নত দেশগুলো বছরে সর্বোচ্চ ৩০০ বিলিয়ন (৩০ হাজার কোটি) ডলার দিতে রাজি হয়েছে। তা-ও ওই অর্থ শুধু তারা একলা দেবে না; চীন, ভারত ও ব্রাজিলের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও তহবিলে অর্থ জমা দিতে হবে।

এ পরিস্থিতিতে আজ রোববার বাংলাদেশ সময় সকালের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে বাকু ঘোষণা আসতে পারে। ওই ঘোষণায় বিশ্বের সব দেশের সম্মতির ভিত্তিতে হবে, নাকি নোট আকারে থাকবে, তা নিয়েও সংশয় রয়ে গেছে। কপ সম্মেলন ১১ নভেম্বর শুরু হয়ে গতকাল শনিবার শেষ হয়েছে।

তবে ঘোষণা যা-ই আসুক, তাতে জলবায়ু–বিপন্ন বিশ্ববাসীর জন্য কোনো আশার বাণী থাকছে না বলে মনে করছেন জলবায়ু আন্দোলনের নেতারা। সুইডেনের আলোচিত জলবায়ু অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ এরই মধ্যে বাকু সম্মেলনের সম্ভাব্য ঘোষণাকে বিশ্বের জন্য ‘মৃত্যু পরোয়ানা’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।

বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান কপ২৯–এর ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করতে স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রেসিডেন্সি কর্তৃক প্রকাশিত নতুন যৌথ পরিমাণগত লক্ষ্য (এনসিকিউজি) বিষয়ক সর্বশেষ খসড়া নিয়ে গভীর হতাশা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বছরে ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দের প্রস্তাব আশ্চর্যজনকভাবে অপ্রতুল। এই বরাদ্দকে অনুদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি এবং এটি কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থার আওতায়ও নেই। এ ছাড়া সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ৪৫টি এলডিসির জন্য কোনো বিশেষ তহবিল বরাদ্দ করা হয়নি।

তবে কপ২৯–এর পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, শিল্পোন্নত দেশগুলোতে প্যারিস চুক্তির বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক নেতারা আবারও ক্ষমতায় ফিরতে শুরু করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প এরই মধ্যে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। কানাডা, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি ও ফ্রান্সেও ডানপন্থীরা জনপ্রিয় হচ্ছেন। ফলে জলবায়ু–বিপন্ন দেশগুলোর চাহিদা অনুযায়ী ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার তহবিলের অর্থ অঙ্গীকার করতে রাজি হচ্ছে না উন্নত রাষ্ট্রগুলো।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বছরে ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দের প্রস্তাব আশ্চর্যজনকভাবে অপ্রতুল। এই বরাদ্দকে অনুদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি এবং এটি কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থার আওতায়ও নেই। এ ছাড়া সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ৪৫টি এলডিসির জন্য কোনো বিশেষ তহবিল বরাদ্দ করা হয়নি।

তবে কপ২৯–এর পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, শিল্পোন্নত দেশগুলোতে প্যারিস চুক্তির বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক নেতারা আবারও ক্ষমতায় ফিরতে শুরু করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প এরই মধ্যে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। কানাডা, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি ও ফ্রান্সেও ডানপন্থীরা জনপ্রিয় হচ্ছেন। ফলে জলবায়ু–বিপন্ন দেশগুলোর চাহিদা অনুযায়ী ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার তহবিলের অর্থ অঙ্গীকার করতে রাজি হচ্ছে না উন্নত রাষ্ট্রগুলো।

অন্যদিকে জাতিসংঘের জলবায়ুবিজ্ঞানীদের সংগঠন আইপিসিসিসি থেকে বলা হয়েছে, এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা আর যাতে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না বাড়ে, সে ব্যাপারে প্যারিস চুক্তিতে অঙ্গীকার করেছিল বিশ্বের সব রাষ্ট্র। কিন্তু এরই মধ্যে গত ২৪ বছরে বিশ্বের তাপমাত্রা ১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। এই শতাব্দীর মধ্যে তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যাতে না বাড়ে, তা নিশ্চিত করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বকে কার্বন নিঃসরণ ৪৩ শতাংশ কমাতে হবে। যে অঙ্গীকার যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, জাপানসহ বিশ্বের প্রধান কার্বন নিঃসরণকারী কোনো দেশই করছে না।

ফলে একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলার অর্থ দিতে রাজি হচ্ছে না উন্নত বিশ্ব। আবার তারা ক্ষয়ক্ষতি কমাতে কার্বন নিঃসরণ কমাতেও রাজি হচ্ছে না। ইউরোপের শীতপ্রধান দেশগুলো এবং যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশ থেকে কার্বন নিঃসরণ কমানো ও তহবিলে অর্থ বাড়ানোর ব্যাপারে অঙ্গীকার বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তা রাষ্ট্রীয় সহায়তা হিসেবে দেওয়া হবে, নাকি ঋণ বা নিয়মিত বৈদেশিক সহায়তার অংশ হিসেবে দেওয়া হবে, তা-ও নিশ্চিত করে বলা হচ্ছে না।

বাকু সম্মেলনে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সমঝোতাকারী দলের সদস্য জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, অনেক হতাশার মধ্যেও বাকু সম্মেলনে সামান্য কিছু অগ্রগতি হয়েছে। শেষ সময়ে এসে তহবিলের অর্থ তারা বাড়িয়েছে। প্যারিস চুক্তির ৯ দশমিক ১ নম্বর ধারা অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার তহবিলে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু–বিপন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলো অগ্রাধিকার পাবে। ফলে বাংলাদেশকে তহবিল পাওয়ার জন্য প্রস্তুতি বাড়াতে হবে।

কপ২৯–এর প্রেসিডেন্টের ঘোষণাপত্র অনুযায়ী, উচ্চাভিলাষী জলবায়ু তহবিলের লক্ষ্যমাত্রায় অবশ্যই উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোকে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। সরকারি ও বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগে ২০৩৫ সালের মধ্যে বছরে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থায়নের জন্য যে দাবি উঠেছে, তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

বাকু সম্মেলনে অংশ নেওয়া ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, জাতিসংঘের জলবায়ু তহবিলে অর্থের পরিমাণ বাড়ানো দরকার। এ জন্য বাংলাদেশকে আরও সোচ্চার হতে হবে, এটা ঠিক। তবে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে ওই তহবিল থেকে প্রকল্প পেতে হলে বাংলাদেশকে অনেক বেশি দক্ষতা বাড়াতে হবে। প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি ও তা বাস্তবায়ন এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য প্রক্রিয়া তৈরি করতে হবে।

জলবায়ু তহবিল থেকে প্রকল্প পেতে হলে বাংলাদেশকে অনেক বেশি দক্ষতা বাড়াতে হবে। প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি, বাস্তবায়ন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতে প্রক্রিয়া তৈরি করতে হবে।
আইনুন নিশাত, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

শেষ মুহূর্তে বর্জন

গতকাল রাতে সম্মেলন শেষ হওয়ার আগমুহূর্তে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পক্ষে ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জোট এওসিস এবং স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে সম্মেলন বর্জনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর দিকে মনোযোগ না দেওয়া এবং ধনী দেশগুলো জলবায়ু তহবিলে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না দেওয়ার অভিযোগ তুলে বর্জনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

জাতিসংঘের বার্ষিক এ সম্মেলন ‘কনফারেন্স অব পার্টিস’ বা কপ নামে পরিচিত। এতে যোগ দেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ বিশ্বের ১০০টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের ৭০ হাজার প্রতিনিধি এতে অংশ নেন।

তবে শিল্পোন্নত ২০ দেশের মধ্যে মাত্র কয়েকটি দেশের নেতারা সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। শিল্পোন্নত দেশগুলো বিশ্বব্যাপী ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমনের প্রায় ৮০ শতাংশের জন্য দায়ী। এ কারণে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের অনেকটা সময়জুড়ে ছিল প্রতিবাদ আর বিক্ষোভ।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১১ নভেম্বর বাকুতে পৌঁছান। সম্মেলনের ফাঁকে তাঁর সঙ্গে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানসহ বেশ কয়েকজন বিশ্বনেতা সাক্ষাৎ করেন।