রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক: কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
রাসেলস ভাইপার সাপ নিয়ে দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এই সাপের কামড়ে মৃত্যুর খবরও পাওয়া যাচ্ছে। আবার কখনো ছড়াচ্ছে মৃত্যুর গুজব। এমন পরিস্থিতিতে এই সাপসহ বিভিন্ন নির্বিষ সাপ নিধনের খবর বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে সাপ নিধনে প্রকৃতির ভয়ানক ক্ষতি হচ্ছে।
রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপের আরেক নাম উলুবোড়া। বিষধর এ সাপটি মাঝে কয়েক বছর খুব কম দেখা গিয়েছিল। গত এক মাসে রাজশাহীর চারঘাট ও গোদাগাড়ী, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ, চাঁদপুরের মতলবসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এর দেখা মিলছে। গত তিন মাসে পদ্মার তীরবর্তী মানিকগঞ্জে অন্তত পাঁচজন প্রাণ হারিয়েছেন এই সাপের দংশনে।
গত বৃহস্পতিবার ফরিদপুর সদরের নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের দুর্গম চরে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে এক কৃষকের মৃত্যু হয়। যশোরে এই সাপের কামড়ে এক শিশুর মৃত্যুর গুজবও ছড়িয়ে পড়ে। এরই মধ্যে কিছু গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ করা হয়, সাপটি ঢাকার কাছে চলে এসেছে। এমন আতঙ্কের মধ্যে এই সাপ মারার জন্য পুরস্কার ঘোষণা এবং দেশের ভেতর সাপটির উপস্থিতি বোঝাতে মানচিত্র তৈরিসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা প্রচার চালানো হচ্ছে।
রাসেলস ভাইপার নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে নির্বিচার সাপ নিধন করা হলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছেন বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী। আজ শনিবার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মানুষ এখন সাপ দেখলেই মনে করছে রাসেলস ভাইপার। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়ায় এমন ঘটছে। যেকোনো সাপ দেখলেই মারা হচ্ছে। এভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, সাপ ইঁদুর খায়। বেজি, বাগডাশ, গন্ধগোকুল, বনবিড়াল সাপ খায়। আবার শঙ্খচূড়, গোখরা, কেউটে—এই সাপগুলোও রাসেলস ভাইপারসহ অন্য সাপ খায়। কিন্তু বন্য প্রাণী দেখলেই তা নিধন করার প্রবণতার কারণে দেশে আশঙ্কাজনকভাবে শিকারি প্রাণী কমে গেছে। ফলে রাসেলস ভাইপার বেড়েছে। এভাবে সাপ মারলে তা খাদ্যশস্য থেকে শুরু করে আরও অনেক বিষয়ের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
বর্ষাকাল সাপের প্রজননকাল। তাই প্রতিবছর এ সময়ে স্বাভাবিকভাবে সাপের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় বলে জানিয়েছে গাজীপুরের শেখ কামাল ওয়াইল্ড লাইফ সেন্টারের সরীসৃপ-সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ সোহেল রানা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এ সময় সাপের দংশনের ঘটনাও বাড়ে। কিন্তু আগে এই খবরগুলো এত গুরুত্ব পায়নি। এখন মানুষের মনে রাসেলস ভাইপার একটি আতঙ্ক হয়ে ঢুকে গেছে।’
সোহেল রানা বলেন, ‘রাসেলস ভাইপার যে বিলুপ্ত হয়েছিল—এ তথ্যটি ভুল। এটি ছিল, তবে তাপমাত্রাসহ বিভিন্ন কারণে ২০০২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত কম দেখা গিয়েছিল। ২০১২ সাল থেকে এটির বিচরণ বেড়েছে। তবে রাসেলস ভাইপার মনে করে এখন সাপ পেলেই মারা হচ্ছে। সাপ মরে গেলে প্রকৃতির অনেক চক্র বাধাগ্রস্ত হবে। তখন এই সাপের কাছ থেকে আমরা যে উপকারগুলো পেয়ে থাকি, তা আর পাওয়া যাবে না।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহসান ‘রাসেলস ভাইপারের পুনরাবির্ভাব ও মানুষের ঝুঁকি’ নিয়ে গবেষণা করছেন। আজ তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বন্যা ও বৃষ্টির জন্য সাপটি শুকনা জায়গা খুঁজে খুঁজে উঠছে। এই সাপের কামড়ে দ্রুত রক্ত জমাট বেঁধে যায়, ফুসফুসের ওপর প্রভাব পড়ে। তাই যে সাপেই কাটুক, রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সাপ পেলেই যে মেরে ফেলা হচ্ছে, এটি খুব ভয়ের খবর।
রাসেলস ভাইপার বিষয়ে জন উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় আজ একটি বিবৃতি দিয়েছে। তাতে সাপ মারাকে দণ্ডনীয় অপরাধ উল্লেখ করে এ থেকে বিরত থাকতে আহ্বান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি বিবৃতিতে সাপের কামড় এড়াতে করণীয়, সাপের কামড়ের পর করণীয় এবং রাসেলস ভাইপারের প্রাদুর্ভাব কমাতে করণীয় বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে।