চানখাঁরপুলে শিক্ষার্থীদের অবস্থান লক্ষ্য করে গুলি, পাঁচজন গুলিবিদ্ধ

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মঙ্গলবার সংঘর্ষে জড়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। রাজধানীর চানখালপুর মোড় এলাকাছবি : সাজিদ হোসেন

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে মঙ্গলবারও গুলি ছুড়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। এতে অন্তত ৫ জন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এ ছাড়া ইটের আঘাতে আহত হয়েছেন অন্তত ২৫ জন শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীদের পূর্বঘোষিত প্রতিবাদ সমাবেশকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার বিকেলে চানখাঁরপুল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় নেতৃত্ব দেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ওমর বিন আব্দুল আজিজ। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ নেতা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ ক্ষমতাসীন দলের কয়েক শ নেতা-কর্মী।

যেভাবে সংঘর্ষ শুরু

শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি মঙ্গলবার ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ সমাবেশের কর্মসূচি ছিল ছাত্রলীগেরও। কিন্তু সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের বেশির ভাগ সমাবেশস্থল রাজু ভাস্কর্য এলাকায় আসতে থাকেন রড, হকিস্টিক, লাঠি, স্টাম্পসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে। দুপুরের এই কর্মসূচিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ঢাকা মহানগরসহ আশপাশের জেলার নেতা-কর্মীরাও জড়ো হন।

লাঠিসোঁটা নিয়ে ছাত্রলীগের অবস্থানের কারণে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাজু ভাস্কর্যে ছাত্রলীগের অবস্থানের কারণে কোটা সংস্কারের দাবি আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীরা জড়ো হন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ আশপাশের এলাকায়। বেলা তিনটার পর বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা সেখানে যেতে থাকেন। তাঁরা ছাত্রলীগের হামলার বিচারের দাবিতে টানা স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় শিক্ষার্থীদের অনেকের হাতে লাঠি, গাছের ডাল দেখা যায়।

শিক্ষার্থীদের জমায়েত শহীদ মিনার ছাড়িয়ে দোয়েল চত্বর, ঢাকা মেডিকেল, কার্জন হল, চানখাঁরপুল পর্যন্ত চলে যায়। অন্যদিকে দুপুরের পর থেকে চানখাঁরপুল এলাকায় অবস্থান নেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা ওমর বিন আবদাল আজিজের লোকজন। তাঁরা সংখ্যায় ছিলেন কয়েক শ। তাঁরা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে থাকেন।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ছিলেন চানখাঁরপুল-সংলগ্ন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পশ্চিম পাশে। এর ১০০ মিটার দূরে নাজিমুদ্দিন রোডের প্রবেশমুখে ছিলেন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নেতৃত্বে ছাত্রলীগসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকেল চারটার দিকে শহীদ মিনারের সামনে দিয়ে একটি বাস ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের সামনে এলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বাসটি থামান। বাসে করে যাচ্ছিলেন কয়েকজন তরুণ। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা জানতে পারেন, ওই তরুণেরা ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী। পরে বাসে থাকা তরুণদের শহীদুল্লাহ হলের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ঘটনার পরপরই কাউন্সিলরের লোকজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ইট-পাথর ছুড়তে থাকেন। তখন শিক্ষার্থীরাও তাঁদের দিকে ইট ছুড়তে থাকেন। একপর্যায়ে সংঘর্ষ বাধে। কাউন্সিলরের লোকজন যে পাশে ছিলেন, সেদিক দিকে গুলি ছোড়া হয়। এ সময় বেশ কয়েক দফা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। এসব ঘটনায় পাঁচ শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হন। তাঁদের রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এই হামলায় আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন।

এর আগে গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতদের নিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচার হামলা চালান। এতে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। এর মধ্যে ছাত্রীদের ব্যাপকভাবে মারধর করা হয়। হামলাকারীদের বেশির ভাগ ছিলেন বহিরাগত, যাঁরা ছাত্রলীগের সঙ্গে ছিলেন। সোমবার পুরো ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের খুঁজে খুঁজে পিটিয়েছে ছাত্রলীগ।

পাল্টাপাল্টি ধাওয়া

মঙ্গলবার বিকেল থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত চানখাঁরপুল এলাকায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের কয়েক দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। এর মধ্যে বিকেল পাঁচটার দিকে শহীদুল্লাহ হলের ছাদে শিক্ষার্থীদের একটি দল অবস্থান নেয়। তখন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা আরও সংগঠিত হয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা করেন। পরে প্রতিরোধের মুখে পিছু হটেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে রাত সাড়ে আটটার দিকে শিক্ষার্থীরা চানখাঁরপুল মোড় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ফিরে যান। তখন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাও সেখান থেকে সরে যান।

তবে পুরান ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা চানখাঁরপুল মোড়ে অবস্থান করছিলেন। পুরো সময়টায় ঘটনাস্থলের আশপাশে পুলিশের ৫০-৬০ জন সদস্য থাকলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাঁদের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। এমনকি শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হলেও অস্ত্রধারীদের ধরতে কোনো ভূমিকা রাখেননি।

সোমবার দুপুরের পর রাতেও হামলা

গত সোমবার দিনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার পর রাতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে তৎপরতা চালায় ছাত্রলীগ। বিভিন্ন কক্ষে গিয়ে আন্দোলনে সক্রিয় থাকা শিক্ষার্থীদের খুঁজতে থাকেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। কয়েকজনকে মারধর করা হয়। বিজয় একাত্তর হলসহ কয়েকটি হলের গেটে পাহারা ছিল ছাত্রলীগের। এ সময় আন্দোলনকারী কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পেটানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। ছাত্রলীগের হুমকির মুখে গত সোমবার রাতে এবং মঙ্গলবার সকালে অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন হল ছেড়ে গেছেন।

তবে শহীদুল্লাহ হল, ফজলুল হক মুসলিম হল ও অমর একুশে হলে এর বিপরীত চিত্র ছিল। এই তিন হলের শিক্ষার্থীরা হামলাকারী ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে সোমবার রাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। শিক্ষার্থীর ওপর হামলায় জড়িত ছাত্রলীগের সাতজন নেতার কক্ষ (ওই তিন হলে) ভাঙচুর করা হয়। এই তিন হলে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে হল ছাড়তে বাধ্য হন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার রাতে অমর একুশে হলের সামনে ছাত্রলীগের বহিরাগত নেতারা মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দিলে শিক্ষার্থীরা তাঁদের ধাওয়া দেন। এ সময় ছাত্রলীগের ওই নেতাদের অনেকে মোটরসাইকেল ফেলে পালিয়ে যান। তখন শিক্ষার্থীরা মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেন।

হামলায় বহিরাগতরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর সোমবারের হামলার ঘটনায় জড়িতদের অধিকাংশই ছিলেন বহিরাগত। হামলাকারীদের ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে এটি নিশ্চিত হওয়া গেছে। সোমবার শুধু ছাত্রলীগ নয়, ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও হামলায় অংশ নেন। হামলার সময় যে পাঁচজনের হাতে অস্ত্র দেখা গেছে, তাঁদের একজন ঢাকা কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ছাত্রীদের ওপর হামলায় ঢাকার বাইরে থেকে আসা ছাত্রলীগের অনেক নেতা-কর্মী অংশ নেন।

অন্যদিকে মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে ছাত্রলীগের যাঁরা জড়ো হন, তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। এমনকি গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন এলাকার নেতা-কর্মীদের নিয়ে আসে ছাত্রলীগ। এঁদের প্রায় সবার হাতেই ছিল লাঠিসোঁটা।

‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান

সোমবারের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার পরও ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম ও শিক্ষকদের তেমন কোনো তৎপরতা ছিল না। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বহিরাগতদের ক্যাম্পাস থেকে সরাতে বারবার দাবি তোলা হলেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে মঙ্গলবার বিকেলে হঠাৎ প্রক্টরিয়াল টিমের কিছু তৎপরতা দেখা যায়। তাঁরা টিএসসি এলাকায় গিয়ে হ্যান্ড মাইকে বহিরাগতদের ক্যাম্পাস থেকে সরে যেতে বলেন। তখন ছাত্রলীগের অবস্থান ছিল রাজু ভাস্কর্যের সামনে।

তবে প্রক্টরিয়াল টিম যখন মাইকে এ ঘোষণা দিচ্ছিল, তখনো লাঠিসোঁটা নিয়ে টিএসসিতে অবস্থান করছিলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। কিছুক্ষণ পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাকসুদুর রহমানসহ সহাকারী প্রক্টররা এসে কয়েকজন নেতা-কর্মীর কাছ থেকে কিছু লাঠিসোঁটা নিয়ে যান। তবে তখনো ছাত্রলীগের অনেকের হাতে লাঠিসোঁটা ছিল। তখন ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ইনান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি মাজহারুল কবিরের সঙ্গে থাকা নেতা-কর্মীদের হাতে রড, হকিস্টিক ও লাঠি দেখা গেছে।

টিএসসি থেকে প্রক্টরিয়াল টিম বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে যায় শহীদ মিনার এলাকায়। সেখানে আগে থেকে অবস্থান করছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা শহীদ মিনার এলাকা থেকে বহিরাগতদের চলে যাওয়ার জন্য মাইকে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। তখন শিক্ষার্থীরা বলছিলেন, যখন বহিরাগতরা হামলা চালিয়েছে, তখন তাঁদের (শিক্ষকেরা) পাওয়া যায়নি। এখন তাঁরা কোথা থেকে এসেছেন।

এ সময় বিক্ষোভকারীরা ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিয়ে প্রক্টরিয়াল টিমের ওপর হামলা চালান। এতে সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক আবদুল মুহিত আহত হন।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মঙ্গলবার রাত পৌনে আটটার পর থেকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে জড়ো হতে থাকেন। রাত সাড়ে আটটার দিকে তাঁরা সেখান থেকে চলে যেতে থাকেন। এর কিছুক্ষণ পর মঙ্গলবারের মতো কর্মসূচি সমাপ্তির ঘোষণা দেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী হাসনাত আবদুল্লাহ। নতুন কর্মসূচি পরে ঘোষণা করা হবে বলে জানান তিনি।