‘কোটাপদ্ধতির সংশোধন চাই, কিন্তু সংশোধনের প্রক্রিয়া চলাকালে পরিপত্র বহাল থাকতে হবে’

ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক পরিপত্রের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি সেই পরিপত্র বাতিল করেছেন উচ্চ আদালত। এরপর আবার আন্দোলন শুরু হয়। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে এই আন্দোলন চলছে। এই প্ল্যাটফর্মের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাহিদ ইসলাম। চলমান আন্দোলন ও পরিস্থিতির সার্বিক দিক নিয়ে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসিফ হাওলাদার

প্রথম আলো:

চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলনে আপনাদের সুনির্দিষ্ট দাবিগুলো কী?

নাহিদ ইসলাম: আমরা চার দফা দাবির কথা বলেছি। একটা রূপরেখা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, যাতে সরকারি চাকরিতে কোটাবৈষম্য স্থায়ীভাবে দূর করা যায়। দাবিগুলো হচ্ছে ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখতে হবে; সেই পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দিয়ে সংবিধান অনুযায়ী শুধু অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করতে হবে; সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটাসুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না ও কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে হবে; এবং দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রথম আলো:

দাবির পক্ষে আপনাদের যুক্তিগুলো কী?

নাহিদ ইসলাম: ৫৬ শতাংশ কোটা প্রথা যে একটা বৈষম্য তৈরি করে এবং নাগরিকের সুযোগের সমতার পরিপন্থী, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। ২০১৮ সালে কোটা বাতিল হওয়ার পর মেধাবীরা সরকারি চাকরিতে আগ্রহী হচ্ছিলেন। এর সুফল দেশ পেত।

প্রথম দাবির ক্ষেত্রে আমরা বলতে চাই, ২০১৮ সালের একটা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে কোটা বাতিল করে দেয়। এখন হাইকোর্টের রায়ে যদি সেটা বাতিল হয়ে যায়, তাহলে ২০১৮ সালের আন্দোলনের সঙ্গে প্রহসন করা হলো। কোটাপদ্ধতি পুনর্মূল্যায়িত হতে পারে, তবে তা এভাবে আদালতের মাধ্যমে নয়। এটা সরকারের নীতির বিষয়।

আন্দোলন ও জনমতের পরিপ্রেক্ষিতেই এই পরিপত্রটি জারি হয়েছিল। তাই কোটার বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত যৌক্তিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হতে হবে। আমরা কোটাপদ্ধতির সংশোধন চেয়েছিলাম, এখনো তা-ই চাইছি। কিন্তু এই সংশোধন প্রক্রিয়া চলাকালে ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল থাকতে হবে।

কোনোভাবেই ৫৬ শতাংশ কোটা ফিরে আসাকে আমরা মেনে নেব না।

দ্বিতীয় দাবির ক্ষেত্রে আমরা মনে করি, শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি নয়, সব গ্রেডেই কোটাবৈষম্য নিরসন করা উচিত। তবে সংবিধান অনুযায়ী শুধু অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম মাত্রায় কোটা রাখতে হবে। এ ছাড়া বাকি অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটাগুলো বাদ দিতে হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতি বা তৃতীয় প্রজন্মের কোটা বা পোষ্যকোটা, এ ধরনের কোটাকে আমরা অযৌক্তিক মনে করি।

তৃতীয় দাবিটি গুরুত্বপূর্ণ এ জন্য যে হরেদরে কোটার ব্যবহারও কমানো উচিত। কিছু সীমারেখা ঠিক করতে হবে, যেমন একাধিক চাকরিতে কোটাসুবিধা পাওয়া বন্ধ করা।

চতুর্থ দাবি, দুর্নীতি বর্তমান আমলাতন্ত্রের একটি বড় সমস্যা। আগের কোটাপদ্ধতির সঙ্গে দুর্নীতির কোনো যোগাযোগ আছে কি না, সেটিও বিবেচনা করা দরকার। রাষ্ট্রের জন্য দক্ষ আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে হলে দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক প্রশাসন গঠন করতে হবে৷

প্রথম আলো:

আদালত যে আদেশ দিয়েছেন, সে বিষয়ে আপনাদের ভাবনা কী?

নাহিদ ইসলাম: হাইকোর্টর রায়ে শিক্ষার্থীরা ন্যায়বিচার পাননি। তাই তাঁরা রাস্তায় নেমে এসেছেন। ৪ জুলাইয়ের শুনানি পেছানো হয়েছে। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ও এখনো পাওয়া যায়নি। কোটা সমস্যা নতুন করে তৈরি হওয়ার দায় নির্বাহী বিভাগ ও সরকারকেই নিতে হবে। সরকারকে আমরা প্রশ্ন করতে চাই, কেন ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করা হলো? এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হয়েছে। যেহেতু নির্বাহী বিভাগের পরিপত্র হাইকোর্ট বাতিল করেছেন, তাই রাষ্ট্রপক্ষ নিয়মতান্ত্রিক কারণে আপিল করেছে। কিন্তু সরকারের জায়গা থেকে আমরা কোনো সদুত্তর পাইনি। রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন বিভাগের এই সমন্বয়হীনতার কারণে মেধাবী শিক্ষার্থীরা কেন বঞ্চিত হবে?

প্রথম আলো:

চলমান আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কেমন সাড়া পাচ্ছেন?

নাহিদ ইসলাম: সারা দেশের শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলন গড়ে তুলছে। দেশে কর্মসংস্থানের অভাব, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি—এমন আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে সরকারি চাকরিতেও কোটাব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা মানে পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দেওয়া। মেধাবীদের হয় দেশ ছাড়তে হবে, নয়তো নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে হবে। সব বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে থাকবেন।

প্রথম আলো:

আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের বিষয়ে আপনারা কতটা আশাবাদী?

নাহিদ ইসলাম: আমরা সম্পূর্ণরূপে আশাবাদী। ২০১৮ সালে তা একবার প্রমাণ হয়েছে। ২০২৪ সালে আবার প্রমাণ হবে।

প্রথম আলো:

আন্দোলনের এই পর্যায়ে আপনাদের পরবর্তী পরিকল্পনা কী?

নাহিদ ইসলাম: আমরা রাজপথের আন্দোলন চালিয়ে যাব। আমরা ঢাকাসহ সব মহানগরে সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচির কথা ভাবছি। সারা দেশের শিক্ষার্থী-প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমরা সংলাপ চালাচ্ছি। এটা কেবল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নয়। অভিভাবক ও নাগরিক সমাজের প্রতিও আমাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আহ্বান থাকবে। রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ও নীতিনির্ধারণ মেধাবীদের হাতে না থাকলে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব নয়।

প্রথম আলো:

আপনাকে ধন্যবাদ।

নাহিদ ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।