‘আমি শামীমির সাতে দ্যাকা করতি চাই। নিজ চোকি তার দেকতি চাই সে অ্যাকন ক্যারাম আচে। তুমরা আমার শামীমির কাচে নি চলো।’ ঘুম ভাঙলেই স্বামীকে একনজর দেখতে এভাবে অস্থির হয়ে উঠছেন সোনিয়া খাতুন। এখনো জানেন না, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তাঁর স্বামী শামীম হোসেন (২২) মারা গেছেন।
সোনিয়ার এমন আহাজারিতে হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, রোগী ও তাঁদের স্বজনদেরও ভারাক্রান্ত করে তুলছে। তাঁকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে অঝোরে কাঁদছেন মা চম্পা খাতুনসহ স্বজনেরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাত আটটার দিকে চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় শামীম হোসেন মারা যান এবং মোটরসাইকেলে থাকা তাঁর স্ত্রী সোনিয়া খাতুন গুরুতর আহত হন। বর্তমানে সোনিয়া চুয়াডাঙ্গার নিউ ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
নিহত শামীম বেগমপুর ইউনিয়নের ফুরশেদপুর গ্রামের নওদাপাড়ার মৃত শফিউদ্দিনের ছেলে। ওই দুর্ঘটনায় সোনিয়া ও তাঁর খালাতো ভাইয়ের স্ত্রী শেফালি খাতুন আহত হয়েছেন।
শেফালি খাতুন তিতুদহ ইউনিয়নের বলদিয়া গ্রামের বিশ্বাসপাড়ার সজীব মিয়ার স্ত্রী। তাঁকে ভর্তি করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে।
এদিকে শামীম হোসেন নিহত হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পার হলেও সোনিয়া খাতুনকে তা জানানো হয়নি। দুর্ঘটনায় ডান হাত ও দুই পা ভেঙে গেছে তাঁর। প্রচণ্ড ব্যথার কারণে তাঁকে বেশির ভাগ সময় ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে।
শুক্রবার রাত আটটার দিকে নিউ ইউনাইটেড হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ঘুমের ঘোরেই বিড়বিড় করে শামীমের নাম উচ্চারণ করছেন সোনিয়া। একটু ঘুম ভাঙতেই শামীমকে একনজর দেখার জন্য মাসহ স্বজনদের কাছে আকুতি জানাচ্ছেন। মা যতই বোঝাচ্ছেন, তাঁর (সোনিয়ার) পা ভাঙা, তাই তাঁকে শামীমের কাছে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। তবু মন মানছে না সোনিয়ার। মুঠোফোনে ভিডিও কলে স্বামীকে দেখতে ও তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন আহত এই নববধূ। বাধ্য হয়ে স্বজনেরা বলেন, দুর্ঘটনার কারণে দুজনের মুঠোফোন এখন পুলিশের কাছে। তাই কথা বলানো যাচ্ছে না। এসব শুনে সোনিয়া চিৎকার করে কান্না করতে থাকেন।
অসুস্থ সোনিয়ার পাশে মা চম্পা খাতুন ছাড়াও ছিলেন মামা খায়রুল ইসলাম, ছোট খালা পপি খাতুন ও খালু বিল্লাল হোসেন। পপি খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়ে শুধু বলছে, তোমার জামুই ক্যারাম আচে? আমি বুলচি, ভালোই আচে।’ খালু বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘মেয়ে খালি জামুইর দেকতি যাতি চাচ্চে। আমি বুজাচ্চি, তোমার যে পা ভাঙ্গা ক্যাম কইরে নি যাব? মুবাইলে ফোন করতি চাচ্চে। আমি বুলচি, সেই ফোন পুলিশির কাচে আটকানো। অ্যাক্সিডেন্ট কইরেচ তুমরা, তাই পুলিশির কাচে রয়েচে। মেয়ে স্যাকন কানচে। আর কুনু কতা বলচে না, শুদু কানচে।’
৯ বছর আগে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয় সোনিয়ার মা চম্পা খাতুনের। এর পর থেকে সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়নের বলদিয়া গ্রামের বিশ্বাস পাড়ায় ছোট ভাই খায়রুল ইসলামের বাড়িতে থাকেন। চম্পা খাতুন বলেন, ‘ছোট থেকেই খেয়ে না খেয়েই মেয়ে দুটোকে মানুষ করেছি। বিয়ে দিয়ে মনে করলাম যে ছাড় পাবুন এট্টু। বিটার (শামীম) আমার কী এট্টা হয়ে গ্যালো।’
টাকার অভাবে অনিশ্চিত অস্ত্রোপচার
সোনিয়া খাতুনের অস্ত্রোপচারে অন্তত ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা লাগবে বলে জানিয়েছেন নিউ ইউনাইটেড হাসপাতালের চেয়্যারম্যান রফিকুল ইসলাম।
এত টাকা কীভাবে জোগাড় করবেন, তা নিয়ে চিন্তিত স্বজনেরা। সোনিয়ার খালু বিল্লাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পরিবারে আসলেই কারুরই তেমন ট্যাকা–পয়সা নেই। ধার-দিনা করে পাঁচ হাজার ট্যাকা নিআইসে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যি দিইচি। অপারেশন করতি অনেক ট্যাকা লাগবে। গ্রামে ও হিজলগাড়ি বাজারে সাহায্য তুলার কতা থাকলিউ হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতি গিয়ে তা পারা যায়নি। কাল সকালতি সাহায্যর জন্যি ছুটতি হবে।’