নির্বাচন কমিশন এক বছরে কি আস্থার সংকট কাটাতে পেরেছে, নাকি উল্টোটা হয়েছে

বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর করণীয় নিয়ে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতবিনিময় করে। তবে এসব বৈঠক থেকে যেসব পরামর্শ এসেছে, সেগুলো কতটা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে
ফাইল ছবি

নির্বাচনব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রতি আস্থার সংকট নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন। আজ সোমবার তাদের দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। আর মাত্র ১০ মাস পর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কিন্তু এখনো ইসির প্রতি মানুষের আস্থার সংকট কাটেনি বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম এক বছরে নির্বাচন কমিশন তাদের কর্মকাণ্ডে যথেষ্ট দৃঢ়তা দেখাতে পারেনি। বরং বিভিন্ন সময়ে তাদের বিতর্কিত মন্তব্য, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার প্রশ্নে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের আপত্তি আমলে না নেওয়া, ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য পাল্টে দেওয়াসহ নানা কারণে আস্থার সংকট আরও বেড়েছে।

দায়িত্ব নেওয়ার ১৫ দিনের মাথায় আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছিল ইসি। কিন্তু সে সংলাপ কার্যত কোনো ফল বয়ে আনেনি। ক্ষমতাসীনদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিসহ ৯টি দল ওই সংলাপ বর্জন করে।

সংলাপে ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যে বক্তব্য দিয়েছিল, পরবর্তী সময়ে তা পাল্টে দেয় ইসি। সংলাপ শেষে ইসি দাবি করে সংলাপে ২৯টি দল ইভিএম নিয়ে মতামত দিয়েছে, এর মধ্যে ১৭টি দলই কোনো না কোনোভাবে ইভিএমের পক্ষে ছিল। সরাসরি ইভিএমের পক্ষে ছিল ১২টি দল। কিন্তু সংলাপে দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর লিখিত প্রস্তাব পর্যালোচনা এবং দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া যায়, ইসি যে ১৭টি দলকে ইভিএমের পক্ষে বলে প্রচার করেছে, তার মধ্যে ৩টি দল সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে। ১টি দলের ইভিএম নিয়ে কোনো মতামত ছিল না। আর ৯টি দল ইভিএম নিয়ে বিভিন্ন শর্তের কথা বলেছিল।

কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনেই ১০ মাস পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে
ফাইল ছবি

পরে নির্বাচন কমিশন আগামী সংসদ নির্বাচনের একটি কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করে। সেখানে নির্বাচনের পথে ১৪টি চ্যালেঞ্জ বা বাধা চিহ্নিত করা হয়। এর প্রথম তিনটি হলো নির্বাচনে অংশহগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা সৃষ্টি, নির্বাচনের দায়িত্বে মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তা বিশেষ করে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন এবং ইভিএমের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা সৃষ্টি। কিন্তু এসব বাধা উত্তরণে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বরং বেশির ভাগ দলের মতামত উপেক্ষা করে ইভিএম ব্যবহার প্রশ্নে নির্বাচন কমিশন অটল অবস্থান নেওয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্ন ও সন্দেহ বেড়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান কমিশন আস্থার সংকট তো দূর করতে পারেইনি বরং সেটা আরও বেড়েছে। ইভিএম নিয়ে তারা বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিচ্ছে।

গাইবান্ধা–৫ আসনের উপনির্বাচনে সব ভোটকেন্দ্রে ছিল সিসি ক্যামেরা। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে কেন্দ্রীয়ভাবে সিসিটিভিতে ভোটের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নির্বাচন কমিশন
ফাইল ছবি

গাইবান্ধা–৫ আসনের উপনির্বাচনে অনিয়মে রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বগুড়ায় উপনির্বাচন নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম যে অভিযোগ এনেছেন, ইসি তা খণ্ডাতে পারেনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপনির্বাচনে একজন প্রার্থী উধাও হয়ে গিয়েছিলেন, ইসি কিছুই করেনি। এগুলো ভালো লক্ষণ নয়।

গত বছরের ফেব্রুয়ারির শেষে বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয়। তাদের অধীনে প্রথম বড় নির্বাচন ছিল গত জুনে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। নির্বাচনে ভোট গ্রহণ সুষ্ঠু হলেও ভোটের আগে–পরে ছিল নানা বিতর্ক। এই নির্বাচনের প্রচারের সময় ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দীনকে এলাকা ছাড়তে বলেছিল ইসি। কিন্তু তিনি না মানেননি বরং ইসির এখতিয়ার নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন। পরে পিছু হঠে ইসি। এই নির্বাচনে ফলাফল ঘোষণা নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়। শেষ সময়ে এসে প্রায় এক ঘণ্টা ফলাফল ঘোষণা বন্ধ রাখা হয়েছিল। মাত্র ৩৪৩ ভোটের ব্যবধানে স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুলকে হারিয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক। ফলাফল ঘোষণার পর মনিরুল হক অভিযোগ তোলেন পরিকল্পিতভাবে তাঁকে এই নির্বাচনে হারানো হয়েছে। একই ধরনের অভিযোগ এনেছেন বগুড়া–৪ আসনের উপনির্বাচনে ৮৩৪ ভোটের ব্যবধানে হেরে যাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম।

বর্তমান কমিশন বেশির ভাগ নির্বাচন করছে ইভিএমে। কয়েকটি নির্বাচনে প্রতিটি ভোটকক্ষে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছিল। এমন একটি নির্বাচন ছিল গাইবান্ধা–৫ আসনের উপনির্বাচন। সেখানে ব্যাপক অনিয়ম ধরা পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ইসি নির্বাচনটি বন্ধ করে দেয়। এটি ছিল নিকট অতীতে ইসির নেওয়া একটি বড় পদক্ষেপ। পরবর্তী সময়ে কমশিন তদন্ত করে ১৩৪ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করে। কিন্তু কোন প্রার্থীর জন্য ভোটে অনিয়ম করা হয়েছিল, ইসির তদন্তে সেটাও উঠে আসেনি। প্রার্থী, স্থানীয় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে কমিশন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অথচ এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, অনিয়ম দেখে তিনি স্থানীয় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এরপরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।

আরও পড়ুন

এই উপনির্বাচনের পর সিসি ক্যামেরার ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কেউ কেউ। এরপর অর্থ সংস্থানের অভাবের কথা বলে সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করা থেকে সরে আসে ইসি। ১ ফেব্রুয়ারি ছয়টি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে আর ভোটকক্ষে সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়নি।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল
ফাইল ছবি

ওই দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ আসনের ভোটে বেশ কয়েকটি ভোটকেন্দ্রে গোপন বুথে অবৈধ ব্যক্তিদের অবস্থান করতে দেখা যায়। তাঁরা নিজেরাই ইভিএমের বোতাম টিপে দেন। পত্রপত্রিকায় এসব অনিয়মের ছবি প্রকাশিত হয়েছিল। তবে ইসি এখানে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ওই নির্বাচনে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী চাপের মুখে ‘নিখোঁজ’ হয়ে ছিলেন। কিন্তু ইসি কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এসব নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতিও ছিল কম।

নিজেদের এক বছরের মূল্যায়ন প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কত সময় পার হলো, প্রথম বছর গেল কিংবা শেষ বছর এল, এটি আমার কাছে মুখ্য নয়। সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছি; এটা করেই যাব। প্রতিটি কাজ স্বচ্ছতার সঙ্গেই করব। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে যত নির্বাচন করেছি, সব কটিই আমরা সততার সঙ্গে আন্তরিকভাবে করেছি এবং প্রত্যাশিত সফলতা অর্জন করেছি। আমাদের কাজের মূল্যায়ন সময়ই বলবে।’

আহসান হাবিব খান বলেন, ‘আমরা কঠোর বার্তা দিতে পেরেছি নির্বাচন ব্যবস্থাপনায়; গাইবান্ধা উপনির্বাচন অনিয়মের কারণে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। সিটি নির্বাচনগুলো সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। ভোটারদের আস্থা ফিরছে। সামনেও নির্বাচন রয়েছে। সংসদ নির্বাচনেও আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে সুন্দর নির্বাচনের।’

চলতি বছরের ডিসেম্বরের শেষে বা আগামী বছরের শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা আছে ইসির। তবে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে এখনো প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোনো সমঝোতার আভাস নেই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যে সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক সংবিধান ও আইনে ইসিকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রয়োগ করতে পারতে হবে। গত দুটি কমিশন তা পারেনি। বর্তমান কমিশনও এখন পর্যন্ত সে দৃঢ়তা দেখাতে পারেনি।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান কমিশনের দৃঢ়তা নিয়ে মাঝেমধ্যে শঙ্কা হয়। এখন পর্যন্ত তারা যা করেছে, তাতে দৃঢ়তার ছাপ দেখা যায়নি। অর্ধেকটা গিয়ে তারা আর এগোতে পারছে না।

আরও পড়ুন