অভিনেত্রী নাবিলাকে কাছে পেয়ে উচ্ছ্বসিত গাজীপুরের কুমুন গ্রামের নারীরা
গ্রামীণফোনের উদ্যোগে সারা দেশের দুই হাজারের বেশি ইউনিয়নে চলছে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক প্রচারাভিযান। যার আওতায় গতকাল সোমবার গাজীপুর সদর উপজেলার বাড়িয়া ইউনিয়নে আয়োজিত হয় উঠান বৈঠক। কুমুন গ্রামের দক্ষিণপাড়ায় আলমগীর হোসেনের বাড়িতে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি স্থানীয় বিভিন্ন বয়সী নারীদের উপস্থিতিতে ছিল জমজমাট। বাড়তি চমক হিসেবে এই উঠান বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী মাসুমা রহমান নাবিলা। তাঁকে কাছে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন গ্রামীণ নারীরা। তাঁদের কয়েকজন কৌতূহলী মনের নানা প্রশ্ন করেন নাবিলাকে।
গৃহিণী খাদিজাতুল কুবরা জানতে চান, কুমুন গ্রাম কেমন লেগেছে? উত্তরে নাবিলা বলেন, ‘গ্রাম মানেই সবুজ পরিবেশ, মাটির রাস্তা, ছায়াঘেরা গাছগাছালি। আর এখন যেহেতু শীতকাল, হিমশীতল একটা আবহ থাকে। যার সবটুকুই এখানে পেয়েছি। আর আপনাদের আন্তরিকতা ও হাসিমুখগুলো বাড়তি পাওয়া। আমার খুব ভালো লেগেছে।’
বৈঠকে অংশ নেওয়া আরেকজন গৃহিণী তাসলিমা বেগম। তাঁর স্বামী থাকেন বিদেশে। ইন্টারনেটে তিনি ভিডিও কলের মাধ্যমে কথা বলেন স্বামীর সঙ্গে। অনুষ্ঠানে আসার আগে স্বামীকে জানান নিজেদের গ্রামে নাবিলার আগমনের কথা। নাবিলার কাছে তাসলিমা জানতে চান তাঁর গ্রামের বাড়ি সম্পর্কে। নাবিলা জানান, সেভাবে কখনো তাঁর গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় যাওয়া হয় না। কিন্তু তাঁর বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সিনেমা ইউটিউবে প্রকাশ হলে সেখানে গ্রামের অনেকেই কমেন্ট (মন্তব্য) করে ভালো লাগার কথা বলেন। নিজেদের গ্রামের মেয়ে হিসেবে তাঁর জন্য শুভকামনা জানান।
উঠান বৈঠকে গ্রামীণ নারীদের ইন্টারনেটের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেন নাবিলা। দৈনন্দিন নানা কাজে নিজের ইন্টারনেট ব্যবহারের অভিজ্ঞতাও শেয়ার করেন। ইন্টারনেট ব্যবহার যেন নিরাপদ হয়, সে ব্যাপারেও সতর্ক করেন গ্রামীণ নারীদের। নাবিলা বলেন, ‘ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ যেমন রয়েছে, তেমনি ভুল করার ঝুঁকিও রয়েছে। তাই ইন্টারনেটে ভুল কিছু দেখা ও করা যাবে না। নারীদের যুগোপযোগী পরিবর্তন ও এগিয়ে যাওয়ার গল্পে ইন্টারনেট যেন হয় ইতিবাচক হাতিয়ার।’
উঠান বৈঠকে অংশ নেন লতিফা বেগম। হাতে একটি কাগজের পাখা। সেটিতে লেখা ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’।
জানতে চাই, ‘আপনার বয়স কত?
‘৮০ বছর আর ২ বছর।’
‘আচ্ছা। আপনি কি স্মার্টফোন, মানে মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন?’
‘হ্যাঁ। আমার তিনখান মোবাইল আছে। আমার তিন ছেলে সৌদি আরবে থাকে। সবাই একখান করে মোবাইল পাঠাইছে।’
‘কী করেন তিনটা মোবাইল দিয়ে?’
‘তিন ছেলের লগে কথা কই। কথা কওয়ার (বলার) সময় তাগো ছবিও (ভিডিও কল) দেখি। মনে অয় সামনাসামনি বইসা কথা বলতেছি।’ ৮২ বছর বয়সী লতিফা বেগমও এসেছিলেন উঠান বৈঠকে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর দুই ছেলে-বউ আর তিন নাত-বউও।
উঠান বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন স্থানীয় বন্ধুসভার সদস্য উম্মে কুলসুম ইস্তিলা। বেশ আনন্দের সঙ্গেই এ দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। উঠান বৈঠকে ইন্টারনেটের প্রতি গ্রামীণ নারীদের আগ্রহ দেখে তিনিও আনন্দিত। নাবিলার কাছে ইস্তিলা জানতে চান, ‘যাঁরা অভিনয় বা উপস্থাপনায় আসতে চান, তাঁদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?’ উত্তরে নাবিলা বলেন, ‘প্রথমেই নিজের কাছে জানতে হবে, আপনি কী করতে চান। তারপর সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে হবে। ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন আর কোনো কিছু শিখতে কারও কাছে যেতে হয় না। সার্চ দিলেই সব তথ্য সামনে চলে আসে। সে অনুযায়ী নিজেকে গড়ার সুযোগ রয়েছে।’ ভবিষ্যতে কুমুন গ্রাম থেকেই হয়তো কেউ বিনোদনজগতে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন নাবিলা।
এদিন উঠান বৈঠকে অংশ নেওয়া আরেক গৃহিণী মাহমুদা সুলতানা। তিনি গাজীপুরের কাজী আজিমুদ্দিন কলেজ থেকে সমাজকর্মে স্নাতকোত্তর করেছেন। স্বামী লুৎফুর রহমান ব্যবসায়ী। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ইন্টারনেটে নাটক, সিনেমা, গান ও খবর সবই দেখেন মাহমুদা। স্থানীয় বন্ধুসভার সদস্য মরিয়মের কাছে উঠান বৈঠকের কথা জানতে পারেন তিনি। এখানে এসে ভালো লাগার পাশাপাশি নাবিলার উপস্থিতি তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে বলে জানান। এ ছাড়া স্বাস্থ্যবিষয়ক কুইজে অংশ নিয়ে পুরস্কার পেয়েও আনন্দিত তিনি।
মাহমুদা সুলতানা বলেন, ‘যাঁকে টিভিতে ও ইউটিউবে দেখি, তিনি আমাদের গ্রামে এসেছেন, প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। উঠান বৈঠকে যদি না আসতাম, অনেক কিছুই মিস করতাম। ইন্টারনেট নিয়ে কম-বেশি আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু এখানে এসে সেগুলো নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জেনে আগের জ্ঞানটা একটু ঝালাই হলো। আর বাড়তি আনন্দ যুক্ত হয়েছে কুইজে অংশ নিয়ে পুরস্কার পেয়ে।’ মাহমুদা জানান, তিনি সংসার সামলানোর পাশাপাশি আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিচ্ছেন। বাসায়ই টিউশনি করান। একটা ভালো চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সে জন্য ইন্টারনেটে বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তিও দেখেন। তবে সুযোগ পেলে ঘরে বসেই অনলাইনের মাধ্যমে কিছু একটা করার পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।
সারা দেশে গ্রামীণ নারীদের জীবনে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ কার্যক্রমটি। মানুষের নানা চাহিদা ও প্রয়োজন মেটাতে ইন্টারনেট যে সক্ষম, সে বিষয়টি প্রান্তিক নারীদের সরাসরি শেখাতে এ উদ্যোগ। প্রথম আলোর পাঠক সংগঠন বন্ধুসভার সদস্যদের সহযোগিতায় সারা দেশের দুই হাজার ইউনিয়নের বেশি স্থানে অনুষ্ঠিত হয়েছে উঠান বৈঠক। উদ্যোগটির সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া ও ঢাকা ব্যাংক পিএলসি। ২০২৩ সালের মার্চে শুরু হওয়া কার্যক্রমটির আওতায় গতকাল পর্যন্ত ২ হাজার ৩৮টি ইউনিয়নে সম্পন্ন হয়েছে উঠান বৈঠক।