সামাজিক মাধ্যমে ভুল তথ্যের ৪২ শতাংশই রাজনৈতিক, প্রধান লক্ষ্য ড. ইউনূস ও শেখ হাসিনা

ডিসমিসল্যাব জানিয়েছে, চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে ফ্যাক্ট-চেক প্ল্যাটফর্মগুলো ৯১৭টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছেপ্রতীকী ছবি: রয়টার্স

চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজনীতি ও ধর্মসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভুল তথ্যের ছড়াছড়ি বেড়ে যায়। এই সময়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশ ছিল। ফলে রাজনৈতিক ভুল তথ্য ছড়ায় ৪২ শতাংশ। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঘিরে ভুল তথ্য ছিল বেশি।

তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব এক প্রতিবেদনে এ কথা জানিয়েছে। ভুল তথ্যের প্রবণতা নিয়ে বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের প্রতিবেদন গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশ করে তারা। বাংলাদেশের আটটি ফ্যাক্ট-চেক ওয়েবসাইটের ফ্যাক্ট-চেক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে ডিসমিসল্যাব।

ডিসমিসল্যাব জানিয়েছে, চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে ফ্যাক্ট-চেক প্ল্যাটফর্মগুলো ৯১৭টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি (৪২শতাংশ) ছিল রাজনৈতিক ভুল তথ্য। যা আগের প্রান্তিকের চেয়ে প্রায় ৩ গুণ এবং প্রথম প্রান্তিকের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি। রাজনৈতিক ভুল তথ্যের পরেই রয়েছে ধর্ম বিষয়ে ভুল তথ্য (সাড়ে ১১ শতাংশ)।

ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে ভুল তথ্য বা অপতথ্যের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এ প্রতিবেদনেও সেটা দেখা গেছে। গত জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের পর এ ধরনের তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা কমে এসেছিল; কিন্তু জুন থেকে তা বাড়তে থাকে।

ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রতিকার প্রসঙ্গে মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, সঠিক তথ্য দিয়ে ভুল তথ্যকে মোকাবিলা করতে হবে। মূলধারার গণমাধ্যমের ওপর মানুষের আস্থা অনেক। তারা ভুল তথ্যগুলোকে আমলে নিয়ে সঠিক তথ্য মানুষকে জানাতে পারে। এতে ডিজিটাল লিটারেসিও তৈরি হবে।

রাজনৈতিক ভুল তথ্যের বিষয়বস্তুতে ড. ইউনূস–শেখ হাসিনা

বাংলাদেশি ফ্যাক্ট-চেকাররা জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রেকর্ড পরিমাণ ১ হাজার ৩৪৫টি ফ্যাক্ট চেক করেছে। যার মধ্যে এককভাবে ৯১৭টি ভুল তথ্য তারা পেয়েছে।

ডিসমিসল্যাব বলেছে, জুন মাসে ভুল তথ্য ছড়ানো শুরু হয়। পরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে জুলাইয়ে ইন্টারনেট বন্ধ করা হলে তখন কিছুটা কমে যায়। এরপর ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে ভুল তথ্য ছড়ানো বাড়তে থাকে। সেপ্টেম্বরে তা শীর্ষে পৌঁছায়।

ডিসমিসল্যাব ভুল তথ্যকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে: ‘নেতিবাচক’ ও ‘ইতিবাচক বা নিরপেক্ষ’। শেখ হাসিনা সম্পর্কিত ভুল তথ্যের প্রায় ৪৯ শতাংশ ছিল তাঁকে মহিমান্বিত করা। অন্যদিকে ড. ইউনূসকে ঘিরে ভুল তথ্যের ৬৫ শতাংশ ছিল নেতিবাচক।

রাজনৈতিক ভুল তথ্য মূলত দুই পক্ষকে ঘিরে ছড়িয়েছে। শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের নেতাদের জড়িয়ে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে, যা ৩৬ শতাংশ। আর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস, তাঁর সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের জড়িয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভুল তথ্য ছড়িয়েছে, যা ৩৫ শতাংশ।

রাজনৈতিক ভুল তথ্যের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে।

ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত বছরগুলোতে সাধারণত বিএনপিকে লক্ষ্য করে ভুল তথ্য ছড়ানো হতো, যা এবার ৮ শতাংশে নেমেছে। তবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং দলটির ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরকে লক্ষ্য করে ভুল তথ্য ছড়ানো বেড়ে ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

ডিসমিসল্যাব ভুল তথ্যকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে: ‘নেতিবাচক’ ও ‘ইতিবাচক বা নিরপেক্ষ’। শেখ হাসিনা সম্পর্কিত ভুল তথ্যের প্রায় ৪৯ শতাংশ ছিল তাঁকে মহিমান্বিত করা। অন্যদিকে ড. ইউনূসকে ঘিরে ভুল তথ্যের ৬৫ শতাংশ ছিল নেতিবাচক।

জুলাই মাসের আন্দোলনকে শেখ হাসিনা কঠোরভাবে মোকাবিলার চেষ্টা করেছেন। সে সময় তাঁকে ঘিরে ভুল তথ্যগুলোর মধ্যে ছিল, সামরিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর চাপ। যেমন ‘নতুন সেনাপ্রধান শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে বলেছেন’, ‘কোটা আন্দোলনের কারণে জাতিসংঘ শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার হুমকি দিয়েছে’, ‘কোটা আন্দোলনের মধ্যে দেশ ছাড়ছেন’।

রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে ভুল তথ্য বা অপতথ্যের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এ প্রতিবেদনেও সেটা দেখা গেছে। গত জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের পর এ ধরনের তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা কমে এসেছিল; কিন্তু জুন থেকে তা বাড়তে থাকে।
মিরাজ আহমেদ চৌধুরী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডিজিটালি রাইট

আগস্ট মাসে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে ভুল তথ্য আরও বেড়ে যায়। যেমন ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হার্ট অ্যাটাক’, ‘শেখ হাসিনা মারা গেছেন’, ‘নরেন্দ্র মোদি হাসিনাকে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন’–এর মতো ভুল তথ্য ছড়ানো হয়।

সেপ্টেম্বর মাসে এসে হাসিনার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি–সংক্রান্ত ভুল তথ্য ছড়ানো হয়। যেমন তাঁর দেশে প্রত্যাবর্তন এবং তিনি এমন নেতা, যিনি বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। তিনি ভারত থেকে বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন, এমন ভুল তথ্যও ছড়ানো হয়।

আগস্টে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. ইউনূসকে জড়িয়ে ভুল তথ্য ছড়াতে থাকে। ড. ইউনূসকে ঘিরে যেসব নেতিবাচক ভুল তথ্য সামনে এসেছে সেখানে আর্থিক ও ব্যবসায়িক বিতর্ক রয়েছে। যেমন ইসরায়েলের সঙ্গে কথিত আর্থিক সম্পর্ক; গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের কোনো কিস্তি দিতে হবে না। এ ছাড়া বিএনপি নেতারা ইউনূসের পদত্যাগের আহ্বান জানাচ্ছেন এবং তিনি বিএনপিকে ক্ষমতা গ্রহণ থেকে বিরত রাখবেন—এমন ভুল তথ্য ছড়ানো হয়।

সেপ্টেম্বর মাসের দিকে ইউনূসকে নিয়ে ভুল তথ্যগুলো জনপ্রিয় ধারার হয়। অর্থাৎ প্রগতিশীল উদ্যোগ এবং রক্ষণশীল মূল্যবোধের সঙ্গে যুক্ত একজন নেতা হিসেবে চিত্রিত করা হয়।

সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেন ইউনূস। সে সময় তাঁকে ঘিরে ছড়ানো ভুল তথ্যের মধ্যে রয়েছে তাঁর পদত্যাগ, দেশে ফিরছেন না, জাতিসংঘে ভাষণ বাতিল, যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার হয়েছেন ইত্যাদি।

ধর্ম বিষয়ে ভুল তথ্য

আগস্টের শুরুতে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলাসংক্রান্ত ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। যেখানে পুরনো ছবি বা ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নয়, এমন ছবি–ভিডিও ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টে এ–সংক্রান্ত ছবি–ভিডিও ছড়ানো হয়। যার বেশির ভাগ অ্যাকাউন্টের উৎস ভারত।

ডিসমিসল্যাব জানিয়েছে, ধর্ম বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের নামে মিথ্যা বিবৃতিও ছড়ানো হয়েছে। যেমন হজ ও ওমরাহ খরচ কমানো নিয়ে ধর্ম উপদেষ্টার বিবৃতি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা সারজিস আলমের নামে একটি ইসলামি রাষ্ট্রের পক্ষে বিবৃতি উল্লেখযোগ্য।

ভিডিওতে বেশি ভুল তথ্য

জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যত ভুল তথ্য ফ্যাক্ট–চেকাররা শনাক্ত করেছেন, তার মধ্যে ভিডিও ৩১ শতাংশ। এরপরে ছবি ২৭ শতাংশ এবং গ্রাফিক কার্ড ১৯ শতাংশ। তবে চলতি বছরের প্রথম দুই প্রান্তিকে ভিডিও ও ছবির মাধ্যমে ছড়ানো ভুল তথ্য আরও বেশি ছিল। তৃতীয় প্রান্তিকে গ্রাফিক কার্ডের মাধ্যমে ছড়ানো ভুল তথ্য বেড়েছে।

গ্রাফিক কার্ডের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভুল তথ্যের মধ্যে ৮১ শতাংশ ছিল প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমের নাম ও লোগো নকল করা। এ ধরনের ভুল তথ্যের প্রায় অর্ধেকই রাজনীতিসংশ্লিষ্ট।