ভালোবাসা-বেদনার কথা উঠে এল বাবা-মেয়ের চিঠিতে

মঞ্চে অতিথিদের সঙ্গে বাছাই করা ২৯ চিঠির লেখকেরা। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আজ ১১ অক্টোবরছবি: প্রথম আলো

নৌকা ডুবে মাছের খাবার নষ্ট হওয়ার বেদনা তখন পরিবারের সদস্যদের। সেই খাবার বাঁচাতে শার্ট খুলে পানিতে নেমেছিলেন বাবা। উঠে দেখেন শার্টের পকেট থেকে টাকা চুরি গেছে। এরপরও হাসিমুখে বাড়ি ফিরেছিলেন বাবা। কারণ, মেয়ের জন্য কেনা নূপুরজোড়া চুরি হয়নি।

রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীর বাসিন্দা শিল্পী আক্তার সেই স্মৃতি তুলে ধরে চিঠি নিবেদন করেছেন বাবার প্রতি। চিঠিতে তিনি আরও লিখেছেন, ‘এ রকম অজস্র সুখময় স্মৃতিতে তুমি আমাদের জড়িয়ে রেখেছ। যে হিজলগাছটার ওপর ভর করে তুমি আমাদের সাঁতার শেখাতে, সেই গাছটা এখনো আছে আগের জায়গাতেই। সব ঠিকঠাক, শুধু তুমি নেই বাবা।’

রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে মো. শরীফ উদ্দিন আহম্মেদ নামের এক বাবা মেয়েকে লিখেছেন মুখে বলতে না-পারা অনেক কথা। চিঠিতে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা নিজের অসুস্থ মায়ের স্মৃতি তুলে ধরেছেন। মেয়ের মধ্যে নিজের মায়ের জন্ম হয়েছে বলে মনে হয় তাঁর। মেয়েকে লিখেছেন, ‘মানুষকে অবহেলা করো না। অবহেলায় মানুষ মৃত্যুর আগেই মরে যায়। জীবন আর জগতের শুদ্ধতা রক্ষার ভার মানুষ হিসেবে কিছুটা হলেও তোমার ওপর আছে।’

চট্টগ্রামের চকবাজারের ফারহানা রহমান চিকিৎসক বাবার কাছে দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা পাওয়ার কথা লিখেছেন। করোনাকালে রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে তাঁর বাবা নিজেই আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

‘কথা হোক, বাবা-মেয়ের চিঠি’ বইয়ে এমন ২৯টি চিঠি স্থান পেয়েছে। বাবা ও মেয়ের পরস্পরের প্রতি এমন ভালোবাসা, হারানোর বেদনা, মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার প্রত্যাশা, এমনকি অভিমান ও ক্ষোভ উঠে এসেছে এসব চিঠিতে।

আজ ১১ অক্টোবর শুক্রবার আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস উদ্‌যাপন এবং ‘কথা হোক’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উঠে আসে বাবা-মেয়ের নানা কথা। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য ‘কন্যাদের চোখে আগামী’। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) ও প্রথম আলো ডটকম যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে ইউএনএফপিএ বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধি মাসাকি ওয়াতাবে বলেন, পরিবার থেকেই জেন্ডার সমতার চর্চা শুরু হওয়া দরকার। প্রথাগতভাবে পরিবারে বাবাদের প্রভাব থাকে বেশি। বাবা সেই প্রভাব থেকে পরিবারে সমতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখলে, কন্যার শিক্ষা নিশ্চিত করলে তা মেয়ের জন্য সুরক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।

প্যানেল আলোচনায় বক্তব্য রাখছে নালন্দা উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী পারমিতা দে মানসী
ছবি: প্রথম আলো

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫৩ বছর হলো। হিসাব মেলাতে গেলে দেখা যায়, মেয়েদের জীবনযাপন এখনো অনেক দুঃসহ। মেয়েদের প্রতি যত্ন নিতে প্রত্যেকের দায়িত্ব পালন করা দরকার। এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে এমন আরও ভালো ভালো উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

ইউএনএফপিএ পরিচালিত একটি প্রচারাভিযান হচ্ছে ‘সেলিব্রেটিং ডটার্স’। ২০২২ সাল থেকে ‘আমার মেয়ে, আমার আগামী’ স্লোগানে শুরু এই প্রচারাভিযানের উদ্দেশ্য হচ্ছে, নারী ও মেয়েদের সঠিক মূল্যায়ন এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মেয়েদের অবদানের স্বীকৃতি ও উদ্‌যাপন।

২০২৩ সালের শেষ দিকে এই প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে প্রথম আলো ডটকমের সহযোগিতায় ‘কথা হোক’ নামে উদ্যোগ নেয় ইউএনএফপিএ। এর লক্ষ্য ছিল, চিঠির মাধ্যমে বাবা ও মেয়ের সুন্দর সুন্দর সম্পর্ককে কথোপকথন আকারে তুলে ধরা। ২০২৪ সালের মার্চের মধ্যে প্রচারাভিযানটি প্রায় ৮৪ লাখ অনলাইন ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছায়। প্রায় ১৬ লাখ পাঠক জানতে পারেন চিঠি লেখার এই আয়োজনের কথা।

এরপর সারা দেশ থেকে আসা তিন শতাধিক চিঠি থেকে ২৯টি চিঠি নিয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ‘কথা হোক, বাবা-মেয়ের চিঠি’ শিরোনামে বই প্রকাশ করে প্রথমা প্রকাশন। বইটির সম্পাদক সাইদুজ্জামান রওশন ও খায়রুল বাবুই।

২৯টি চিঠির মধ্যে দুটি চিঠি সেরা নির্বাচিত হয়। এর মধ্যে একটি লিখেছেন নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার ফজলে এলাহী। তিনি মেয়ে তাহিয়াতকে উদ্দেশ্য করে ‘তুমিও কি ফিরবে না একদিন?’ শিরোনামের চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমার জীবনে আমি তেমন কিছুই করে দেখাতে পারিনি। তোমার ওপর আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছেড়ে দেব, এতটা নিষ্ঠুর আমি নই। আমি চাই তুমি নিজের কথা শোনো। নিজের স্বপ্ন নিজেই বাস্তবে রূপ দাও।’

সেরা দুই চিঠির পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক দেবাশ্রিতা পাল প্রাচুর্য ও ফজলে এলাহী (ডানের দুজন)
ছবি: প্রথম আলো

সেরা অন্য চিঠিটি লিখেছেন দেবাশ্রিতা পাল প্রাচুর্য। রাজধানীর খিলগাঁওয়ের এই বাসিন্দা ‘এক যে ছিল সাধারণ রাজা’ শিরোনামে বাবার উদ্দেশে চিঠি লিখেছেন। চিঠির লাইনে লাইনে বাবার প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা লেখা। তিনি লিখেছেন, ‘ছেলে নেই আপনার? স্রেফ দুটো মেয়ে?’ এ ধরনের প্রশ্ন হেসে উড়িয়ে দিয়ে আমাদের আগলে রাখার জন্য ধন্যবাদ, বাবা।’

বাবার প্রতি অভিমান ও ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখা চিঠিও স্থান পেয়েছে বইটিতে।

বাবাকে নিয়ে বিদ্বেষ-ভালোবাসামিশ্রিত আবেগে চিঠি লিখেছেন মিরপুরের বাসিন্দা ৮০ বছর বয়সী আমেনা খাতুন। বাবা ১৬ বছর বয়সে পাকিস্তান এয়ারলাইনসে কর্মরত এক তরুণের সঙ্গে বিয়ে দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বামী মারা গেলে তিনি চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে করাচি থেকে ঢাকায় চলে আসেন। ভাই-ভাবিদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতির কাছে মাথা নত করে বাবা তাঁকে আবার বিয়ে দিতে চান এবং সন্তানদের একেকজনের সংসারে ভাগ করে দিতে চান। তাতে আমেনা খাতুন রাজি না হলে চুয়াত্তরের বন্যার সময় সন্তানসহ তাঁকে বাবা শ্বশুরবাড়িতে দিয়ে যান।

সেই বাড়িতেও ছিল প্রতিকূল পরিবেশ। একা লড়াই করে সন্তানদের তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ‘জীবনঝড়ে ঝরে যাইনি’ শিরোনামের চিঠিতে আমেনা খাতুন লিখেছেন, ‘মানুষ যখন বাবা দিবসে বলে, পৃথিবীতে কিছু খারাপ পুরুষ আছে। কিন্তু একটিও খারাপ বাবা নেই। আমার তখন হাসি পায়। কষ্ট বুকে চেপে অনেক কথা লিখলাম, বাবা। যেখানেই আছ ভালো থেকো।’

রাজধানীর উত্তরার সিরাজাম মনিরা মিলির চিঠিতে আভাস যে তিনি নিজের পছন্দ বিয়ে করেছেন। সেই ‘ভুলের’ কারণে ২০ মাসের বেশি সময় ধরে বাবা তাঁর খোঁজ নেন না। ‘প্রিয় বাবা’ সম্বোধন করে লেখা সেই চিঠির ইতি অংশে লেখা, আপনার ‘মৃত’ সন্তান।

বাবার বাল্যবিবাহ দেওয়ার চেষ্টা মা প্রতিরোধ করেছিলেন। বাবার ভয়ে লুকিয়ে রাত জেগে পড়াশোনা করতেন মেয়ে। ‘অন্য বাবাদের’ মতো নিজের বাবা যত্ন ও দায়িত্ব নেননি জানিয়ে আক্ষেপভরা চিঠিতে উত্তরার উমামা খালেদ লিখেছেন, ‘বাবা, অভিযোগের ঝাঁপি খুলে বসেছি আজ। বলে মনটা একটু হালকা করতে দাও প্লিজ।’

অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষক প্রিয়াঙ্কা গোপ
ছবি: প্রথম আলো

বাবার সহযোগিতা আত্মবিশ্বাস বাড়ায়

প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সের আগে অর্ধেক মেয়ের বাল্যবিবাহ হচ্ছে। বাল্যবিবাহের কারণে অল্প বয়সে গর্ভধারণ এবং মা ও শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে। মেয়েরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। পরিবার থেকে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে মেয়েদের জন্য সুন্দর পরিবেশ গড়া সম্ভব।

পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব খ ম হারূন বলেন, নারীর প্রতি অমর্যাদাকর বার্তা দেয়, এমন কিছু গণমাধ্যমে প্রচার করা উচিত নয়। এখন প্রতিবেশী দেশের অনেক নাটকে মেয়েদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়। সেসব আমাদের দেশের দর্শকদের ওপরও প্রভাব ফেলে।

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক কথাসাহিত্যিক আফসানা বেগম বলেন, সব দিক দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে মেয়েদের সামনে এগিয়ে নেওয়ার চর্চা পরিবারের মধ্যে থাকা উচিত।

ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারের প্রধান ইসমত জাহান বলেন, বাবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক একটি মেয়েকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

নালন্দা উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী পারমিতা দে মানসী বলে, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় বাবা রয়েছেন। তাই কন্যার প্রতি বাবার ভালোবাসা ও সহযোগিতা থাকলে তা কন্যার আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।

অনুষ্ঠানে ‘কথা হোক’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন ইউএনএফপিএর ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধি এবং প্রথম আলোর সম্পাদক। শিল্পী আক্তারের ‘‍আমি এখন নূপুর পরি না’ চিঠি পাঠ করেন বদরুন্নেসা কলেজের শিক্ষার্থী আফসারা জামান প্রতিভা।

সেরা চিঠির একটির ওপর ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। মিলনায়তনের বাইরেও চিঠি ও বাবা-মেয়ের বিভিন্ন আবেগঘন আলোকচিত্র প্রদর্শনী হয়।

অনুষ্ঠানে বাছাই করা ২৯ চিঠির লেখককে সনদ ও ক্রেস্ট উপহার দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানের উন্মুক্ত পর্বে কয়েকজন বাবা নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানান।

অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষক প্রিয়াঙ্কা গোপ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থী অনুভা ঐশী। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন রুহানি সালসাবিল।