তথ্যচিত্রে ফিরে দেখা
পলান সরকার নেই, আছে তাঁর লাইব্রেরি
পলান সরকার। নিজে পড়াশোনা না করতে পারলেও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করার জন্য নিজের টাকায় বই কিনে বাড়ি বাড়ি দিয়ে আসতেন। ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো তাঁকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০০৯ সালে স্থানীয় জেলা পরিষদ তাঁর বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে। রাষ্ট্রের বিশেষ সম্মান একুশে পদকে তাঁকে ভূষিত করা হয়। ২০১৯ সালের ১ মার্চ না ফেরা দেশে চলে গেছেন তিনি। এখন কেমন চলছে পলান সরকারের পাঠাগার?
পলান সরকার। কেউ তাঁকে বলেছেন বইপ্রেমী। কেউ বলেছেন বইপাগল। শিশুরা বলেছে ‘বইদাদু’। যে নামেই ডাকা হোক, মানুষটির জন্মই হয়েছিল যেন জ্ঞানের আলো ছড়াবার জন্য। তিনি বলতেন, ‘সবচেয়ে বড় দান হচ্ছে জ্ঞানদান। তাই আমি পণ করেছি, যেটুকু পারি আমি বড় দানই করে যাব।’
তাই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করার জন্য নিজের টাকায় বই কিনে বাড়ি বাড়ি দিয়ে আসতেন। আবার পড়া বই ফেরত নিয়ে নতুন বই দিয়ে আসতেন নিজেই। ২০১৯ সালের ১ মার্চ না–ফেরার দেশে চলে যান পলান সরকার। কিন্তু তাঁর পাঠাগার থেকে বই নিয়ে এলাকার মানুষ আলোকিত হচ্ছে। শারীরিকভাবে পৃথিবীতে না থাকলেও পলান সরকার যেন রয়েছেন প্রতিটি বইয়ের মাঝে।
১৯২১ সালের ১ আগস্ট নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার নূরপুর মালঞ্চী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বইপাগল এই মানুষটি। সেখানেই তিনি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। শৈশবে বাবা হারানোর পর আর পড়াশোনা হয়নি।
২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে প্যারিসভিত্তিক একটি সংগঠন ‘স্পার্ক নিউজ’ ইতিবাচক উদ্যোগের ওপর লেখা আহ্বান করে। বাংলাদেশ থেকে ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ শিরোনামে পলান সরকারের বই পড়ার আন্দোলন নিয়ে লেখা পাঠায় প্রথম আলো। ২০ সেপ্টেম্বর লেখাটি সারা পৃথিবীর ৪০টি প্রধান দৈনিকে ছাপা হয়। এর মধ্যে ১০টি পত্রিকার প্রধান শিরোনাম হয় ‘আলোর ফেরিওয়ালা’।
শেষের দিকে পলান সরকার বই পড়ার আন্দোলনটাকে শুধু তাঁর পাঠাগারকেন্দ্রিক না রেখে একটু অন্যভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। বই বিতরণের জন্য এলাকাভিত্তিক পাঁচটি ‘বিকল্প বই বিতরণ কেন্দ্র’ তৈরি করেন। এ জন্য কোনো বাজারের বইপ্রেমী দোকানিকে তিনি বেছে নেন। দোকানমালিক তাঁর দোকানে মালামালের পাশাপাশি পলান সরকারের বইও রাখেন। সেখান থেকে স্থানীয় লোকজন বই নিয়ে যান।
পড়া বই তাঁরা নিজেরাই আবার ফেরত দিয়ে নতুন বই নিয়ে যান। মাসে এক-দুবার করে পলান সরকার দূরবর্তী এই কেন্দ্রগুলোতে ছেলে হায়দার আলীর সঙ্গে মোটরসাইকেলে চেপে গিয়ে নতুন বই দিয়ে পুরাতন বই নিয়ে আসতেন। তবে শেষ বয়সে এই কাজগুলো ছেলে হায়দার আলীকে দিয়েই বেশি করাতেন। মৃত্যুর পরও তাঁর পাঠাগার চলছে সমানভাবে। স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পাঠাগার থেকে বই নিয়ে যায়।
পড়া বই আবার ফেরত দিয়ে যায়। একুশে পদকের সঙ্গে যে অর্থ পেয়েছিলেন তা পলান সরকার নষ্ট করেননি। সেই টাকা ব্যাংকের স্থায়ী আমনত হিসেবে রেখে দিয়েছেন। সেখান থেকে যে মুনাফা আসে তা তাঁর পাঠাগারের কল্যাণে ব্যয় করা হয়।