১০৯৯ ইউনিয়নে উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত
ইন্টারনেটের আলোয় ফিরোজা আক্তার দেখছেন উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন
কিশোরগঞ্জ জেলার মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে নরসুন্দা নদী। সেই জেলারই অন্যতম উপজেলা মিঠামইন। হাওর অধ্যুষিত এলাকা মিঠামইন ইউনিয়নের অন্যতম একটি গ্রাম কামালপুর। সেই গ্রামেরই স্থানীয় ঈদগাহ ময়দানে এ বছরের ৭ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে তিনটা থেকে শুরু হয় ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ কার্যক্রমের আওতায় উঠান বৈঠক। আয়োজনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব ছিল ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা। এ পর্বে অংশগ্রহণকারী গ্রামীণ নারীদের মধ্যে দ্রুত সময়ে সঠিক উত্তর দিয়ে স্মার্টফোন জেতেন গৃহিণী ফিরোজা আক্তার সাথী।
ফিরোজার পুরস্কার পাওয়ার অভিজ্ঞতা এটাই প্রথম নয়। কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার ইটনা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাঁর এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে বহুবার। স্কুলে একবার ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা এঁকে জেতেন জ্যামিতি বক্স। উপস্থিত সবার করতালির মাধ্যমে পুরস্কার গ্রহণ করে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন তিনি। সেই সময় সামনে ছিল সহপাঠীরা, তবে এবার স্মার্টফোন জেতার আনন্দময় মুহূর্তে ছিল পরিবারের সদস্যরা। ফলে ফিরোজার আনন্দের মাত্রাটা কয়েকগুণ বেশি। প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘যহন আমি পুরস্কারটা লইতেছিলাম তহন আমার ফরিবারের সবই আমার দিকে চাইয়া হাততালি দিতাছে। আমার যে কি বালা লাগছে, বইলা বুঝাইতে ফারব না। মনে হইছে, অতদিনে আমি কিছু একটা করতাম পারছি।’
ইন্টারনেট যে মানুষের নানাবিধ চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণ করতে পারে—বিষয়টি সরাসরি শেখাতে গ্রামীণফোনের উদ্যোগে দেশ জুড়ে চলছে উঠান বৈঠক। ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ উদ্যোগটির সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া ও ঢাকা ব্যাংক পিএলসি। গ্রামীণ নারীদের ইন্টারনেট বিষয়ক জ্ঞান বাড়াতে দুই হাজার ইউনিয়নে আয়োজিত হচ্ছে উঠান বৈঠক। প্রতি পর্বে বিজয়ীদের দেওয়া হয় আকর্ষণীয় পুরস্কার। বিশেষ একটি পর্বে সুযোগ রয়েছে ঢাকা ব্যাংকের সৌজন্যে স্মার্টফোন জেতার। এ ছাড়া রয়েছে আকর্ষণীয় মূল্যছাড়ে নকিয়ার মোবাইল হ্যান্ডসেট কেনার সুযোগ। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে শুরু হওয়া বিশেষ কার্যক্রমটি গতকাল বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন বিভাগের ১০৯৯টি ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আবার ফেরা যাক গৃহিণী ফিরোজা আক্তার সাথীর গল্পে। স্বামী, এক ছেলে ও এক মেয়েসহ চারজনের পরিবার। স্বামীর আয়েই সংসার চলে, তিনি কাজ করেন কম্পিউটার কম্পোজ-ফটোকপির দোকানে। সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও ফিরোজা এসবের মধ্যেই নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চাননি। সব সময় ভাবতেন ‘আমাকেও কিছু একটা করতে হবে’। প্রতিবেশী কানিজ ফাতেমার কাছ থেকে পান সরকারি এক প্রশিক্ষণ প্রকল্পের খোঁজ। তারপর আর থেমে থাকেননি তিনি। সপ্তাহের শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিনই মিঠামইনের নিজ বাড়ি থেকে নৌকায় আধা ঘণ্টা হাওর পাড়ি দিয়ে যান ইটনা বাজারে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ‘হার পাওয়ার প্রকল্পের’ (HER Power project) আওতায় নেওয়া শুরু করেছেন কম্পিউটার বিষয়ক প্রশিক্ষণ। শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বেলা দুটা পর্যন্ত চলে প্রশিক্ষণ। শিখছেন মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল ও পাওয়ার পয়েন্টসহ প্রাথমিক নানা বিষয়াদি। প্রকল্প থেকে পেয়েছেন বিনা মূল্যে ল্যাপটপ। কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে নিজের জন্য কেনা হয়নি একটি স্মার্টফোন। গ্রামীণফোন আয়োজিত উঠান বৈঠকে এসে পূরণ হয়েছে তাঁর সেই স্বপ্ন।
এখন তিনি নিজেকে মেলে ধরতে চান ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠিত হতে চান নারী উদ্যোক্তা হিসেবে। ফিরোজার প্রাথমিক অনুপ্রেরণা প্রতিবেশী পপি ও ফাতেমা, যাঁরা ‘হার পাওয়ার প্রকল্প’ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে হয়েছেন সফল উদ্যোক্তা। তবে মূল অনুপ্রেরণা পেয়েছেন উঠান বৈঠকে অংশগ্রহণ করে। ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ নামটা শুনে ইন্টারনেটের প্রতি আগ্রহ থেকেই উপস্থিত ছিলেন আয়োজনে। সেখানে প্রদর্শিত সফল উদ্যোক্তাদের ভিডিও দেখে হয়েছেন আত্মবিশ্বাসী।
তাঁরা যদি পারে, আমিও পারব—এমনই প্রত্যয় মনের মধ্যে গেঁথে নিয়েছেন ফিরোজা আক্তার। সেই লক্ষ্যে উঠান বৈঠকে পুরস্কার হিসেবে জেতা স্মার্টফোনে সময় পেলেই ঘুরছেন ইন্টারনেটের দুনিয়ায়। গুগল বা ইউটিউবে সার্চ করে সহজেই খুঁজে নিচ্ছেন প্রয়োজনীয় তথ্য। দেখছেন গ্রামে বসেও ইন্টারনেটের মাধ্যমে আয় করা নারীদের সফলতার গল্প। পাচ্ছেন উদ্যোক্তা হওয়ার সাহস ও উৎসাহ। পাশাপাশি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ থেকে শেখা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পরিকল্পনা করছেন অনলাইন থেকে আয়ের। এ ছাড়া নতুন স্মার্টফোনে এখন কম্পিউটার ক্লাসের অনেক অ্যাসাইনমেন্ট সম্পন্ন করতে পারছেন ফিরোজা। তাঁর পরিবারের বিশ্বাস, ভবিষ্যতে গ্রামীণ নারীদের ইন্টারনেট বিষয়ক কোনো প্রশিক্ষণ-আয়োজনে বলা হবে ফিরোজা আক্তার সাথীর সফলতার গল্পও।