ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের কথিত আব্বা বাহিনীর প্রধান বাছের উদ্দিন এলাকায় ফিরেছেন। তিনি এই বাহিনীর মাঠের নেতা আফতাব উদ্দিন ওরফে রাব্বির বাবা। বাছেরকে ঘিরে আবারও সক্রিয় হয়েছেন বাহিনীর সদস্যরা। এতে এলাকার মানুষের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
আব্বা বাহিনীর টর্চার সেলে সাইফুল ইসলাম ওরফে রাসেল নামের নিজেদেরই এক সদস্যকে নির্যাতন করে হত্যার পর থেকে আব্বা বাহিনী পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বাবা-ছেলে এলাকা ছেড়ে যান। পরে রাসেল হত্যার ঘটনায় ছেলে আফতাব পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলেও বাবা বাছের ছিলেন আত্মগোপনে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাছের উদ্দিন এলাকায় ফিরেই ভোল পাল্টেছেন। এখন তিনি বলছেন, ‘ছেলে (আফতাব) অপরাধ করলে তাঁর বিচার হবে।’ এ বিষয়ে প্রথম আলোকেও তিনি প্রায় একই কথা বলেছেন। বাছের আজ রোববার বলেন, ‘আমি অসুস্থ। দুবার স্ট্রোক করেছি। রাসেলের পরিবার আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছে। এই রাসেল আমার এখানে মানুষ হয়েছে। এখন তার পরিবার অপপ্রচার চালিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে। আর আমার ছেলে আফতাব অপরাধ করলে তার বিচার হবে। আমরা চাই, প্রকৃত দোষীদের বিচার হোক।’
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, ঢাকার উপকণ্ঠে বুড়িগঙ্গার ওপারে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নে বাবা-ছেলের ‘আব্বা বাহিনী’ সক্রিয়। বাবা বাছের উদ্দিন শুভাঢ্যা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। আর ছেলে আফতাব উদ্দিন ছিলেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। রাসেল হত্যাকাণ্ডের পর ১২ জানুয়ারি তাঁকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
শুভাঢ্যা ইউনিয়নের কালীগঞ্জ এলাকার একাধিক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিন ধরে বাছের উদ্দিনকে এলাকায় দেখা যাচ্ছে। তাঁর সঙ্গে চলাফেরা করেন তাঁদের বাহিনীর সদস্যরা। এলাকায় এঁদের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় তাঁরা আতঙ্কিত।
গুদারাঘাট এলাকার ঝুট ব্যবসায়ী কবির হোসেন বলেন, রাসেল হত্যার পর আব্বা বাহিনীর কাউকে এলাকায় দেখা যায়নি। এতে এলাকায় শান্তি ফিরেছিল। আফতাবের কিছু সহযোগী আবারও তৎপর হচ্ছে। এতে তিনিসহ ব্যবসায়ীরা শঙ্কিত।
আব্বা বাহিনী আলোচনায় আসে গত ১০ জানুয়ারির পর। চাঁদার টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারাকে কেন্দ্র করে ওই দিন সাইফুল ইসলামকে টর্চার সেলে ছয় ঘণ্টা ধরে নির্যাতন করে হত্যা করেন আব্বা বাহিনীর সদস্যরা। তাঁকে নির্মম নির্যাতনের ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়।
সমালোচনার মুখে পুলিশ আফতাবসহ বাহিনীর ১২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।
নিহত সাইফুলের স্ত্রী মৌসুমি আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামী হত্যার ২৫ দিন পেরিয়ে গেছে। মামলার অনেক আসামি এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। আসামিরা তাঁর (রাসেলের স্ত্রী) পরিবারকে হুমকি দিচ্ছে। বিষয়টি পুলিশকে জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি তিনি।
পুলিশের কেরানীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহাবুদ্দিন কবিরও জানিয়েছেন, মামলার এজাহারে নাম আছে এমন ৫-৬ জনকে এখনো গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, আব্বা বাহিনী গড়ে উঠতে শুরু করে বছর দশেক আগে। ইউপি চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন ও তাঁর ভাই বাছের (আফতাবের বাবা) বহু আগে থেকেই দলবল নিয়ে চলতেন। সেই দলবলই পরে বাহিনীতে রূপ নেয়। সেটির মূল ব্যক্তি এখন বাছের। মাঠে বাহিনীর নেতৃত্ব দেন তাঁর ছেলে আফতাব। প্রশ্রয়দাতা ইউপি চেয়ারম্যান ইকবাল।
শুরুতে এটি আব্বা বাহিনী নামে পরিচিত ছিল না। নামটি এসেছে সাম্প্রতিককালে। বাহিনীর ‘মাঠের নেতা’ আফতাবকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা ‘আব্বা’ বলে ডাকেন। কারণ, তাঁর চাচা ইকবাল হোসেন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শুভাঢ্যা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। নেতাদের মুখে আব্বা ডাকের কারণে আফতাবের বাহিনীর নাম আব্বা বাহিনী হয়েছে।
‘টর্চার সেল’ থেকে ছবি সরিয়ে নিলেন ইউপি চেয়ারম্যান
আব্বা বাহিনী দুটি টর্চার সেল পরিচালনা করে। এর মধ্যে একটি শুভাঢ্যা ইউনিয়নের চর মীরেরবাগ এলাকায় ইউপি চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেনের কেনা বাড়িতে। ওই বাড়ি তত্ত্বাবধান করতেন আমির হোসেন নামের এক ব্যক্তি, যিনি রাসেল খুনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন।
২৮ জানুয়ারি ‘বুড়িগঙ্গার ওপারে আব্বা বাহিনী’ শিরোনামে প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর ইউপি চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন তাঁর চর মীরেবাগের ওই বাড়ির সামনের দেয়ালে টাইলসের ওপর ছাপানো নিজের ছবি সরিয়ে ফেলেন।