জার্মানির মূলধারার সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের খবর
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে বাংলাদেশে হয়ে যাওয়া সংঘাত-সহিংসতা নিয়ে এক সপ্তাহজুড়ে জার্মানির প্রথম সারির বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম খবর প্রকাশ করেছে। একই সময়ে গত কয়েক দিনে জার্মানির বিভিন্ন শহরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা কোটা আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন।
বার্লিনভিত্তিক দৈনিক টাগেসস্পিগেল গতকাল বুধবার ছাপা সংস্করণে প্রথম পাতায় বাংলাদেশ নিয়ে প্রধান খবর প্রকাশ করেছে। চার কলামের খবরটিতে চার কলামজুড়ে ঢাকার রাজপথের একটি ছবি ছাপা হয়েছে। শিরোনাম করেছে ‘বাংলাদেশ যেন মৃত্যুপুরী’। এ ছাড়া পত্রিকাটি নিজেদের রাজনীতিবিষয়ক পাতার পৃষ্ঠাজুড়ে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে নানা খবর প্রকাশ করেছে।
দৈনিক ডি জাইট গত মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) বাংলাদেশের সহিংসতা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে। তারা লিখেছে, সহিংস-বিক্ষোভের পর সরকারি খাতে কোটাপদ্ধতি ব্যাপক সংস্কার করেছে বাংলাদেশে সরকার। এখন কোটা রাখা হয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। (সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এই রায় দিয়েছেন।) বিষয়টি নিয়ে আদালতের রায়ের আগে বিক্ষোভ হয়, পুলিশের সঙ্গে (আন্দোলনকারীদের) সংঘাত হয়, একপর্যায়ে তা সহিংস রূপ ধারণ করে।
ডি জাইটের খবরে বলা হয়, স্থানীয় গণমাধ্যম ১৮০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে। বিক্ষোভকারীরা অসংখ্য যানবাহন ও সরকারি ভবনে আগুন দিয়েছে। ইন্টারনেট সেবা এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি। কারফিউ ধীরে ধীরে শিথিল করা হচ্ছে।
সবশেষে পত্রিকাটি লিখেছে, ২০০৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দরিদ্র, মুসলিম–অধ্যুষিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেশটির জনগণের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে।
আরেক দৈনিক ডের স্পিগেল গত সোমবার (২২ জুলাই) ‘কেন বাংলাদেশ সরকার ১৭ কোটি মানুষকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, প্রথমে কোটাপদ্ধতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা ঢাকার রাস্তায় নামেন। সহিংস ছাত্র অসন্তোষের পর সরকারি চাকরিতে পদ পূরণে বিতর্কিত কোটাপদ্ধতি বাতিল করেছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও তরুণদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্বের হার নিয়েও আন্দোলনকারীদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিক্ষোভকারী ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সহিংস সংঘর্ষে বহু মানুষ নিহত হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে গত শুক্রবার থেকে কারফিউ জারি করে সরকার। গত বৃহস্পতিবার থেকে ইন্টারনেট ও এসএমএস পরিষেবা বন্ধ রয়েছে। পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার সেনাবাহিনী ডাকে।
ফ্রাঙ্কফুরইটার অ্যালগেমাইনে জাইটুং লিখেছে, বাংলাদেশে বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পর দেশটির সর্বোচ্চ আদালত বিতর্কিত কোটাপদ্ধতির পুনঃপ্রবর্তন বাতিল করেছেন। রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট সরকারি খাতে বিতর্কিত কোটাপদ্ধতি আংশিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বাংলাদেশে ভালো বেতনের কাজ বেশ বিরল।
জার্মানির টাজ পত্রিকার এশিয়া–বিষয়ক সম্পাদক স্ভিন হানসেন বাংলাদেশের চলমান আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন, কারফিউ, ইন্টারনেট বন্ধ, গণগ্রেপ্তার, সহিংস সামরিক সহিংসতা, এমনকি গুলি করার নির্দেশ দিয়ে বাংলাদেশে সরকার গত সপ্তাহের ব্যাপক বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। তবে সহিংস বিরোধিতা বিকল্প নয়। বিক্ষোভগুলো ছিল মূলত দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা সরকারের ওপর (সাধারণ মানুষের) ক্ষোভ প্রকাশ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর সহিংসতার প্রবণতা ও ইসলামপন্থীদের সঙ্গে সমঝোতা দেশটির জন্য প্রকৃত কোনো বিকল্প নয়।
এদিকে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্ট সংঘাত-সহিংসতা ও হয়রানির প্রতিবাদে জার্মানির বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ-সমাবেশ হয়েছে। জার্মানিতে অবস্থানরত শিক্ষার্থী ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা মিউনিখ, ফ্রাঙ্কফুর্ট, ডুসেলডর্ফ, হামবুর্গ ও রাজধানী বার্লিনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। গতকাল বার্লিনে জার্মানির চ্যান্সেলর ভবনের সামনে চলমান আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বিক্ষোভ করা হয়েছে।
এই বিক্ষোভ সমাবেশ নিয়ে টাগেসস্পিগেল লিখেছে, বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের সঙ্গে সংহতি জানাতে বুধবার বিকেলে বার্লিন চ্যান্সেলারির সামনে প্রায় ২৩০ বিক্ষোভকারী জড়ো হন। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে নারী ও শিশুও ছিল। বিক্ষোভকারীরা প্ল্যাকার্ডে ১৯০ জনের বেশি মানুষকে হত্যার বিচার চেয়েছেন। সমাবেশে বেশ কয়েকজন বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছেন।