ভঙ্গুর পুলিশ, প্রতি ধাপে প্রয়োজন সংস্কার

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে পুলিশে নিয়োগ হয়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার। এই সময়ে বরাদ্দ বেড়েছে ৪৩৩ শতাংশ। কিন্তু পুলিশকে পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার কার্যকর কোনো উদ্যোগ ছিল না; বরং পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের অতিরিক্ত পুলিশ নির্ভরতায় বাহিনীটির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দেড় মাসেও পুলিশ কার্যকর ভূমিকায় যেতে পারছে না। মহাপরিদর্শক (আইজি) থেকে শুরু করে সব শীর্ষ পদে পরিবর্তন এনেও পুলিশের ভঙ্গুর পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। এ অবস্থায় পুলিশি ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক সংস্কারের দাবি উঠেছে। এ জন্য বাহিনী পরিচালনায় পুলিশ কমিশনের পাশাপাশি সদস্যদের অপরাধ তদন্তে পুলিশ অভিযোগ কমিশন গঠনেরও দাবি উঠেছে।

পুলিশের বর্তমান ও সাবেক সদস্য, সংশ্লিষ্ট সংগঠন ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে বাহিনীর সংস্কারের বিষয়ে বেশ কিছু পরামর্শ ও ধারণা পাওয়া গেছে। তাঁরা মূলত দুই ধরনের পরামর্শ দিয়েছেন। প্রথমত, পুলিশ সদস্যদের বদলি, পদোন্নতি, নিয়োগ, কার্যক্রম পরিচালনা ও সঠিক কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পুলিশকে সেবামুখী করতে এবং মামলা ও এর তদন্ত, গ্রেপ্তার এবং অভিযানসহ সব ক্ষেত্রে জবাবদিহির আওতায় আনতে শক্ত কাঠামো তৈরি করতে হবে। এ জন্য পুলিশ-সংক্রান্ত কিছু আইন ও বিধান যুগোপযোগী করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পুলিশের জনবল, সুযোগ-সুবিধা ও কাঠামোগত এসব উন্নয়ন বাহিনীকে জনমুখী করে তুলতে পারেনি। কারণ, জনগণের কল্যাণের চেয়ে পুলিশকে খুশি করার চেষ্টাই ছিল বেশি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, অতীতে পুলিশের পেশাদার হতে না পারার পেছনে জনবল–সংকট, বাজেটস্বল্পতা ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতাকেই প্রধান কারণ হিসেবে দেখানো হতো। তবে ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৩) এই ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। এই সময়ে পুলিশে ৮৩ হাজার ৭০টি পদ সংযোজন করা হয়। ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য উচ্চপর্যায়ের ১৭৮টি পদ সৃষ্টি করা হয়। ১ লাখ ২০ হাজার জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়। এই জনবলের বড় অংশই নেওয়া হয় দলীয় ও রাজনৈতিক বিবেচনায়। জননিরাপত্তা বিভাগের গত নভেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে পুলিশের মোট সদস্যসংখ্যা প্রায় ২ লাখ ১৩ হাজার।

২০০৯-১০ অর্থবছরে পুলিশের বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৩৩১ কোটি ২৯ লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই বরাদ্দ ৪৩৩ দশমিক ২৮ শতাংশ বেড়ে হয় ১৭ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকার বেশি। এই সময়ে উল্লেখযোগ্য অবকাঠামো নির্মাণ হলেও এর বড় অংশই ছিল অপরিকল্পিত। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পুলিশের জনবল, সুযোগ-সুবিধা ও কাঠামোগত এসব উন্নয়ন বাহিনীকে জনমুখী করে তুলতে পারেনি। কারণ, জনগণের কল্যাণের চেয়ে পুলিশকে খুশি করার চেষ্টাই ছিল বেশি। পরপর তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে বাহিনীর বড় অংশ দলীয় কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। নির্বাচনে জিততে দলীয় নেতা-কর্মীদের পরিবর্তে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল বিগত সরকার।

পুলিশের দুজন প্রতিনিধিসহ কমিশনের আকার ১০-১২ সদস্যের হতে পারে। গণমাধ্যম, বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ ও পুলিশ সদস্যদের বক্তব্য আমরা শুনব। মানুষ যেমন পুলিশ বাহিনী দেখতে চায়, আমরা সে ধরনের বাহিনী গঠনের পরামর্শ দেব।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব সফর রাজ হোসেন

এ অবস্থা থেকে বের করে পুলিশকে সচল করতে জবাবদিহির স্থায়ী কাঠামো তৈরির প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তাঁর পরামর্শ, ইংল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের পাশাপাশি পুলিশ অভিযোগ কমিশন গঠন করতে হবে। নিয়োগ-বদলি, পদোন্নতিসহ পেশাগত উৎকর্ষ সাধনে স্বাধীনভাবে কাজ করবে পুলিশ কমিশন। অভিযোগ কমিশন তাদের এসব কাজের ক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করবে।

পুলিশের বিভিন্ন বিষয়ের সংস্কার ও তথ্যানুসন্ধানে বাহিনীটির সদর দপ্তর ইতিমধ্যে আটটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটিগুলো প্রতিবেদন প্রস্তুত করে পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) দেবে বলে জানিয়েছেন সদর দপ্তরের মুখপাত্র ইনামুল হক।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। এই কমিশনের প্রধান সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব সফর রাজ হোসেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘পুলিশের দুজন প্রতিনিধিসহ কমিশনের আকার ১০-১২ সদস্যের হতে পারে। গণমাধ্যম, বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ ও পুলিশ সদস্যদের বক্তব্য আমরা শুনব। মানুষ যেমন পুলিশ বাহিনী দেখতে চায়, আমরা সে ধরনের বাহিনী গঠনের পরামর্শ দেব।’

পুলিশের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মূলত যেখানে ক্ষমতা বেশি, অপরাধ বেশি, ব্যবসা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান বেশি, সেসব এলাকায় পদায়নের আলাদা চাহিদা রয়েছে। এর মূল কারণ, এসব জায়গায় অবৈধ আয়ের সুযোগ বেশি। কেবল ক্যাডার কর্মকর্তারা নন, কনস্টেবল থেকে পরিদর্শক পর্যন্ত পুলিশের প্রতিটি পর্যায়ের বেশির ভাগ সদস্য এসব এলাকায় পদায়ন পেতে চান।

পদায়নের ধারণায় পরিবর্তন জরুরি

পুলিশ সদস্যদের সাধারণত ১৬ থেকে ২০ ধরনের ইউনিট, প্রতিষ্ঠান কিংবা কর্মক্ষেত্রে পদায়ন হয়ে থাকে। পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, এর মধ্যে ৩-৪ ধরনের পদায়নকে ‘ভালো পদায়ন’ হিসেবে বিবেচনার প্রচলন আছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অপরাধ বিভাগ ও গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগসহ কিছু পদ, জেলা পুলিশের পুলিশ সুপার ও রেঞ্জের ডিআইজিকে পুলিশে সবচেয়ে ভালো পদায়ন মনে করা হয়। এর বাইরে পুলিশ সদর দপ্তর, পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ (সিআইডি) ইউনিটগুলোর কিছুসংখ্যক পদকে ভালো পদায়ন হিসেবে বিবেচনার প্রচলন আছে। বিগত ১৫ বছরে ঘুরেফিরে নির্দিষ্ট কিছু কর্মকর্তাই এই ‘ভালো পদায়ন’ পেয়েছেন।

পুলিশের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মূলত যেখানে ক্ষমতা বেশি, অপরাধ বেশি, ব্যবসা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান বেশি, সেসব এলাকায় পদায়নের আলাদা চাহিদা রয়েছে। এর মূল কারণ, এসব জায়গায় অবৈধ আয়ের সুযোগ বেশি। কেবল ক্যাডার কর্মকর্তারা নন, কনস্টেবল থেকে পরিদর্শক পর্যন্ত পুলিশের প্রতিটি পর্যায়ের বেশির ভাগ সদস্য এসব এলাকায় পদায়ন পেতে চান।

পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পদায়নের জন্য কোনো ‘ফিটলিস্ট’ (যোগ্য তালিকা) নেই। ফলে যেকোনো সময় যাঁকে খুশি যেকোনো জায়গায় পদায়নের সুযোগ রয়েছে। মূলত এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পদায়ন ঘিরেই শুরু হয় পুলিশের রাজনীতি। আর এই রাজনীতিই পুলিশের পেশাদার বাহিনী হওয়ার ক্ষেত্রে মূল প্রতিবন্ধকতা।

তুলনামূলক ভালো পদে যেতে বাহিনীর প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা দিতে হয় অন্য কর্মকর্তাদের। কোথাও কোথাও আবার স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের চাওয়া অনুযায়ী পদায়ন হয়। কর্মকর্তাদের কেউ কেউ আবার সিন্ডিকেট তৈরি করে বদলি-পদোন্নতির পুরো প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করেন। এ জন্য তাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। কখনো আবার পদায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে অবৈধ অর্থ লেনদেন। এ কারণে পদায়নে কখনোই শৃঙ্খলা আসে না।

পদায়নে শৃঙ্খলা আনতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নেরও দাবি উঠেছে পুলিশের অভ্যন্তরে। এ বিষয়ে পুলিশের পরিদর্শক থেকে ডিআইজি পদমর্যাদার ১৩ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁদের পরামর্শ হলো, প্রশাসন ক্যাডারে যেভাবে জেলা প্রশাসক হিসেবে পদোন্নতির জন্য ‘ফিটলিস্ট’ করা হয়, সেভাবে পুলিশ সুপার (এসপি) হিসেবে পদায়নের জন্যও ফিটলিস্ট করতে হবে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে পদায়নের জন্যও ফিটলিস্ট থাকতে হবে। এসব পদে যেতে বিশেষায়িত ও সুনির্দিষ্ট জায়গায় কাজের অভিজ্ঞতা যুক্ত করে দিতে হবে।

ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, এসপি ও ওসি পদে কত দিন থাকতে পারবেন, তা সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। বিশেষায়িত ইউনিটগুলো ছাড়া অন্য সব ইউনিটে সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাজের বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে ভালো-খারাপ পদায়ন বলে কিছু থাকবে না। তাহলে সবার সব জায়গায় কাজ করার মানসিকতা তৈরি হবে।

পদোন্নতিতে প্রয়োজন শৃঙ্খলা

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঊর্ধ্বতনদের সুনজর, রাজনৈতিক বিবেচনা অথবা আর্থিক লেনদেন ছাড়া ওপরের পদগুলোতে পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। এ কারণে পেশাদার হওয়ার পরিবর্তে দলের স্বার্থে বা রাজনৈতিক নেতাদের নজরে থাকা যায় এমন কাজে বেশি আগ্রহী হন পুলিশের সদস্যরা। ফলে পুলিশ বাহিনী গণমানুষের বাহিনী হয়ে উঠতে পারে না।

এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরামর্শ হলো, পদোন্নতির ক্ষেত্রে যোগ্যতার কিছু মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিতে হবে। বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনকে (এসিআর) সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। ‘চেইন অব কমান্ড’ নিশ্চিতে এসিআর প্রদানের ক্ষমতা এককেন্দ্রিক না রেখে পরিদর্শক, সহকারী পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, পুলিশ সুপারসহ ওপরের সব পর্যায়ে বিন্যস্ত করতে হবে।

এ ছাড়া কনস্টেবল নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও আমূল পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছেন পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, মামলার তদন্তে থাকা এসআইদের অর্ধেক সরাসরি নিয়োগ পান। বাকিরা কনস্টেবল থেকে পদোন্নতি পান।

ঢেলে সাজাতে হবে থানা, বাড়াতে হবে প্রশিক্ষণ

সাধারণ সেবা পেতেও থানায় পুলিশের হয়রানির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। মামলা, সাধারণ ডায়েরি (জিডি), তদন্ত, টহল ও অভিযানসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুলিশের বিরুদ্ধে অসহযোগিতাপূর্ণ কিংবা হয়রানিমূলক আচরণের অভিযোগ পাওয়া যায়। এসব কাজে অর্থ লেনদেন অধিকাংশ থানায় একধরনের অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। ফলে থানাগুলো জনগণের সেবা পাওয়ার ভরসাস্থল হয়ে উঠতে পারেনি। এ কারণে সারা দেশে পুলিশের ৬৩৯টি থানা (মেট্রোপলিটনের ১১০টি ও জেলার ৫২৯টি) ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

থানা সংস্কারের ক্ষেত্রে পুলিশের সাবেক ও বর্তমান এবং বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বেশ কিছু পরামর্শ পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো প্রতিটি থানার পুলিশ সদস্যদের সার্বক্ষণিক কার্যক্রম তদারকির জন্য স্বাভাবিক নজরদারির বাইরেও জেলাগুলোতে ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি স্বতন্ত্র দল থাকবে। তাঁরা প্রতিদিনের অসংগতিগুলো তুলে এনে সরাসরি এসপি এবং রেঞ্জ ডিআইজিকে প্রতিবেদন দেবেন। এ ছাড়া প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক সেবাপ্রত্যাশীর সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো অবৈধ লেনদেন হয়েছে কি না বা কেউ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন কি না জানতে চাইবেন। সে অনুযায়ী অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

এ ছাড়া কনস্টেবল নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও আমূল পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছেন পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, মামলার তদন্তে থাকা এসআইদের অর্ধেক সরাসরি নিয়োগ পান। বাকিরা কনস্টেবল থেকে পদোন্নতি পান। কিন্তু কনস্টেবলদের যখন নিয়োগ হয়, তখন তাঁদের মামলার তদন্তের উপযোগী করে প্রস্তুত করা হয় না। তাঁরা যখন পদোন্নতি পেয়ে এসআই হন, তখন মামলা তদন্তের দায়িত্ব পান। ফলে মানসিকভাবে প্রস্তুত না হওয়ায় তাঁদের অনেকেই তদন্তে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারেন না। এ জন্য নিয়োগের সময় এবং পদোন্নতির আগেই তাঁদের তদন্তের জন্য প্রস্তুত করা জরুরি।

পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক নাইম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের মনোবল ফিরিয়ে থানাগুলোকে সচল করাই এখন প্রধান কাজ। এরপর বদলি ও পদোন্নতির সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা করা প্রয়োজন। এই নীতিমালার ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী চিন্তা করে সব পর্যায়ের প্রশিক্ষণও সময়োপযোগী করতে হবে।

বিশেষায়িত জনবল নিয়োগ

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের ধরন ও দমনের কৌশলেও বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে সাইবার অপরাধ ও উগ্রবাদী কার্যক্রম মোকাবিলায় পুলিশকে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পুলিশে সাইবার ক্রাইম ইউনিট, সোয়াট, অ্যান্টিটেররিজম ইউনিট (এটিইউ) ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) মতো বিশেষায়িত ইউনিট গঠিত হলেও বিশেষায়িত জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তবে অনেককে এসব ইউনিটে পদায়ন দিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা কিছুদিন পর আবার বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। ফলে প্রশিক্ষণ কাজে লাগছে না।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরামর্শ হলো, বিশেষায়িত ইউনিটগুলোতে প্রাথমিকভাবে কনস্টেবল ও এসআই পদে বিশেষায়িত জনবল নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। পরে এই জনবলকে প্রশিক্ষিত করে নিয়মিত পদোন্নতির মাধ্যমে পুরো ইউনিট বিশেষায়িত জনবল দিয়ে পরিচালিত হতে পারে। তদন্তনির্ভর ইউনিটগুলোতে পদায়নের জন্যও কিছু মানদণ্ড নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া ট্যুরিস্ট পুলিশ, রেল পুলিশ, শিল্প পুলিশ, নৌ পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটসহ সব ইউনিটে বিশেষায়িত জনবল নিয়োগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কেউ কেউ।

সময়ের প্রয়োজনেই পুলিশ সংস্কার করতে হবে এবং এই প্রক্রিয়া চলমান রাখতে হবে। তবে এই সংস্কারের পুরোপুরি সুফল পেতে হলে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। সে ক্ষেত্রে পুলিশের পাশাপাশি বিচারব্যবস্থা ও অপরাধীদের সংশোধনের জন্য কারাগার ব্যবস্থাপনাকেও ঢেলে সাজাতে হবে।
পুলিশের সাবেক আইজি খোদা বখশ চৌধুরী

জবাবদিহির কাঠামো গড়ে তুলতে হবে

পুলিশ সদস্যদের অধিকাংশ অপরাধের নেপথ্যেই রয়েছে ঘুষ ও অবৈধ লেনদেন। এর বাইরে সাধারণত আচরণগত, ব্যক্তিগত ও দায়িত্বে অবহেলার ঘটনায় পুলিশ সদস্যরা অভিযুক্ত হন। তবে আলোচিত না হলে খুব কম ঘটনার ক্ষেত্রে অভিযুক্ত সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়। আবার যেসব তদন্ত হয়, সেগুলোও পুলিশই করে থাকে। ফলে নানা কৌশলে বড় অপরাধ করেও লঘু শাস্তি কিংবা অভিযোগ থেকে পার পেয়ে যান অপকর্মে জড়ানো পুলিশ সদস্যরা।

এ অবস্থায় পুলিশের জবাবদিহির জন্য শক্ত কাঠামো গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, কার্যকর পুলিশ অভিযোগ কমিশনের মাধ্যমে পুরো বাহিনীকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। সব অপরাধ, অসংগতি ও অপকর্মের তদন্ত এই কমিটি তদন্ত করবে। তা ছাড়া সদস্যদের দৃশ্যমান অপরাধগুলোর পাশাপাশি প্রতিটি মামলা ও তদন্তের জন্য তাঁদের জবাবদিহি করতে হবে। এর সঙ্গে প্রত্যেক পুলিশ সদস্য ও পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দিতে হবে। তাঁদের মোট সম্পদ ও আয়ের উৎস নিয়ে অসংগতি থাকলে ব্যবস্থা নিতে হবে।

পুলিশ সংস্কার নিয়ে বহু বছর ধরে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তা পরের সরকার আর বাস্তবায়ন করেনি। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অতীতের সরকারগুলো পুলিশ বাহিনীকে তাঁদের লেজুড়বৃত্তির জন্য উৎসাহিত কিংবা বাধ্য করেছে। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েই জরুরি ভিত্তিতে এই পরিবর্তনগুলো করতে হবে। যেসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সময় লাগবে, সেগুলোও একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে এনে কাজ শুরু করে দিতে হবে।

পুলিশের সাবেক আইজি খোদা বখশ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সময়ের প্রয়োজনেই পুলিশ সংস্কার করতে হবে এবং এই প্রক্রিয়া চলমান রাখতে হবে। তবে এই সংস্কারের পুরোপুরি সুফল পেতে হলে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। সে ক্ষেত্রে পুলিশের পাশাপাশি বিচারব্যবস্থা ও অপরাধীদের সংশোধনের জন্য কারাগার ব্যবস্থাপনাকেও ঢেলে সাজাতে হবে।