‘এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল জীবন সুন্দর’
‘চূড়ার খুব কাছাকাছি চলে আসার পর উত্তেজনা বাড়তে থাকে। নিজেকে নিজে বলতে থাকলাম, আর কিছু দূর, তারপর পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের ওপরে উঠে যাব। চূড়ায় পৌঁছানোর পর নিচে তাকালাম। মনে হলো জীবন সুন্দর। প্রায় ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট উপভোগ করলাম হিমালয়ের অপার্থিব সৌন্দর্য।’
এভারেস্ট ও লোৎসের চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে ফেরা পর্বতারোহী বাবর আলী এভাবেই এভারেস্ট জয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের বর্ণনা করলেন। আজ বুধবার বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম নগরের চকবাজারে অবস্থিত আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের মিলনায়তনে গিয়ে পাওয়া গেল বাবরকে। অভিযানের বিস্তারিত জানাতে সেখানে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল বাবরের ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স। সংবাদ সম্মলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার পাশাপাশি প্রথম আলোর সঙ্গেও একান্তে কথা বলেছেন তিনি।
বাবর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবচেয়ে উঁচু পর্বত থেকে পৃথিবীকে কিছু সময়ের জন্য দেখার দৃশ্য কখনো ভুলব না। চূড়া থেকে তিব্বতের দিকে যখন তাকালাম, তখন নিজেই নিজেকে বলে উঠেছিলাম, শাবাশ। এটা দারুণ মুহূর্ত।’
বাবর আলী একই অভিযানে এভারেস্ট ও লোৎসের মতো দুটি ৮ হাজার মিটারের পর্বতে ওঠার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন। দীর্ঘ প্রশিক্ষণও নিতে হয়েছে তাঁকে। সফলভাবে অভিযান শেষ করে আসতে পেরেছেন। দেশে ফিরে সবার শুভেচ্ছা পাচ্ছেন। এ মহাকাব্যিক অভিযানের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল বছরখানেক আগে থেকেই। বাবর ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরি করেছেন। অত্যাবশ্যকীয় সব উপকরণ, বিশেষ করে ট্রেকিং বুট, মোজা, গ্লাভস, থার্মাল, ফ্লিস এবং ভেতরে ও বাইরে পরার অন্যান্য পোশাক সংগ্রহ করেছেন। এককথায় শতভাগ প্রস্তুত হয়ে পা বাড়িয়েছেন এ অভিযানে।
বাবর বলেন, ‘ঠিকঠাক প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ভারত থেকে প্রশিক্ষণও নিতে হয়েছে। এ কারণে অভিযান নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল না। এ কারণে প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়েছি মেপে মেপে।’
পরতে পরতে মুগ্ধতা
এভারেস্ট ও লোৎসে অভিযানের জন্য বাংলাদেশ থেকে বাবর আলী নেপালের উদ্দেশে রওনা হন গত ১ এপ্রিল। প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করে ৪ এপ্রিল কাঠমান্ডু থেকে উড়ে যান লুকলা। এরপর পথচলা শুরু করেন এভারেস্ট বেজক্যাম্পের উদ্দেশে। সেখানে পৌঁছান ১০ এপ্রিল। পরে ২৬ এপ্রিল বেজক্যাম্প থেকে এভারেস্টের ক্যাম্প ২ পর্যন্ত ঘুরে এসে উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পর্ব সমাপ্ত করেন।
এরপর অনুকূল আবহাওয়ার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয় বাবরকে। ১৪ মে মাঝরাতে বেজক্যাম্প থেকে বাবরের যাত্রা শুরু হয় চূড়া অভিমুখে। ১৫ মে সকালে পৌঁছে যান ক্যাম্প ২-এ। পরিকল্পনা অনুযায়ী, সেখানে দুই রাত কাটিয়ে বাবর উঠে যান ক্যাম্প ৩-এ।
সেখান থেকে ১৮ মে পৌঁছান ক্যাম্প ৪-এ। ২৬ হাজার ফুট উচ্চতার এই ক্যাম্পের ওপরের অংশকে বলা হয় ‘ডেথ জোন’। ১৮ মে মাঝরাতে আবারও শুরু হয় বাবরের যাত্রা। আবছা আলোয় পথ চলতে হয় তাঁকে। ১৯ মে ভোরের আলোয় ২৯ হাজার ৩১ ফুট উচ্চতার মাউন্ট এভারেস্টের শীর্ষে ওড়ান বাংলাদেশের পতাকা।
পথে যেতে যেতে কী দেখলেন বাবর, এমন প্রশ্নে বলেন, ‘পরতে পরতে মুগ্ধতা ছিল। ২ হাজার মিটার উচ্চতায় যে গাছ দেখেছি, সে একই গাছ ৪ হাজার মিটার উচ্চতায় গিয়ে অন্য রকম হয়ে গেছে। আবহাওয়া ও উচ্চতা অনুযায়ী এসব গাছ নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। আয়তনে ছোট হয়ে ঝোপঝাড়ে পরিণত হয়েছে। যত ওপরে উঠেছি, ততই মুগ্ধ হয়েছি।’
তবে অভিযানের শুরু থেকেই কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় বাবর আলীকে। তুষারপাত কম হওয়ার কারণে খুম্বু আইসফল বা বরফের প্রপাত পাড়ি দিতে দেরি হয়েছে তাঁর। বেজক্যাম্প থেকে ক্যাম্প-১–এ যেতে খুম্বুর দেখা পাওয়া যায়। সাধারণত আবহাওয়া ভালো থাকলে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টায় এ পথ পাড়ি দেওয়া যায়। কিন্তু তাঁর সময় লেগেছে ৮ ঘণ্টার মতো।
১৯ মে ভোরে এভারেস্টচূড়ায় ওঠার পর শুরু হয় নেমে আসার যুদ্ধ। নামার সময় শুরু হয় তুষারঝড়। কোনোভাবে এক পাশে ঘণ্টা দুয়েক বসে ছিলেন বাবর। তুষারের ঝাপটা এসে পড়ছিল তাঁর শরীরে। শনশন বইছিল উত্তাল হাওয়া। এ কারণে ক্যাম্প-৪-এ ফিরতে দেরি হয়ে যায়। বাবর জানালেন, সেই ঝড়ের মুখোমুখি হওয়ার পর মনে হচ্ছিল, এই বুঝি বিপদ হবে। তবে সে–যাত্রায় ঝড়টি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। তাই দুর্ঘটনা ছাড়াই নেমে আসতে পেরেছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিমালয়ে পড়েছে বলে জানালেন বাবর। তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে হিমালয়ের হিমবাহ সরে যাচ্ছে। শক্ত স্বচ্ছ নীল বরফ বেরিয়ে আসছে। এর ফলে অভিযানও কঠিন হচ্ছে।
পূর্ণিমার আলোয় চকচক করছিল লোৎসে
পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণের দুদিন পর লোৎসে পর্বতের শীর্ষে (৮৫১৬ মিটার) ওঠেন ৩৩ বছর বয়সী বাবর আলী। ২১ মে নেপাল সময় সকাল ৫টা ৫০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় ৬টা ৫ মিনিট) বাবর লোৎসে পর্বতচূড়ায় পা রাখেন।
এভারেস্টের চেয়ে লোৎসের যাত্রাটিই বেশি আনন্দ দিয়েছিল বলে জানালেন বাবর। বাবর বলেন, ‘লোৎসের পথ বেয়ে যেদিন উঠছিলাম, সেদিন ছিল পূর্ণিমা। পূর্ণিমার কোমল আলোয় বরফখণ্ডগুলো চকচক করছিল। সোনালি আভা তৈরি হয়েছিল। চূড়ায় ওঠার পর এভারেস্টের দিকেও একবার তাকাই। ১০ মিনিটের মতো লোৎসের চূড়ায় ছিলাম। ওই সময়টা জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত হিসেবে থেকে যাবে। পরে মাত্র তিন ঘণ্টায় নিচে নেমে আসি।’
‘দেশ হতে দেশ দেশান্তরে’
বাবর শুধু পর্বতে চড়েন না। তিনি সাইকেল চালিয়ে রেকর্ডও করেন। হেঁটে হেঁটে দেশ ঘুরে আসেন। যেমন গত বছরের ১৩ এপ্রিল কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে সাইকেলযাত্রা শুরু করেছিলেন এ পর্বতারোহী। এক মাসের চেষ্টায় প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী গিয়ে থেমেছিলেন তিনি। পথে যেতে যেতে ১৩টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মনোরম দৃশ্য অবলোকন করার সুযোগ হয়েছিল তাঁর।
এর আগে ২০১৯ সালে পরিবেশ রক্ষার ব্রত নিয়ে বাংলাদেশের ৬৪ জেলা হেঁটে পার করেন তিনি। তারও আগে ২০১০ সালে ট্রেকিং–জগতে বাবর আলীর হাতেখড়ি হয়। ওই বছর পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন দুর্গম পাহাড় চষে বেড়ান তিনি। সফলতার সঙ্গে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পর তাঁর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। কীভাবে বিশ্বের বড় বড় পর্বতে উঠবেন, সেই পরিকল্পনা চলতে থাকে মস্তিষ্কে। এরপর গত এক দশকে হিমালয়ের নানা পর্বত জয় করেছেন পেশায় চিকিৎসক বাবর আলী। এর মধ্যে ২০২২ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে হিমালয়ের অন্যতম দুর্গম চূড়া আমা দাবলাম (২২ হাজার ৩৪৯ ফুট) আরোহণ করেন বাবর।
বাবর প্রথম আলোকে বলেছেন, তিনি ঘরে বসে থাকেন না। বেরিয়ে পড়েন অজানাকে জানার ও অদেখায় দৃষ্টি রাখার উদ্দেশ্যে। অন্তরের বাইরের ডাক তিনি সব সময় শুনতে পান।
বাবরের এসব কর্মকাণ্ডের পর এ কথা বললে ভুল হবে না যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সংকল্প কবিতাটি তাঁকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। কবি লিখেছিলেন, ‘পাতাল ফেড়ে নামব নিচে, উঠব আবার আকাশ ফুঁড়ে/ বিশ্ব–জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।’
বাবর আলীও জাতীয় কবিকে স্মরণ করলেন। তিনি বললেন, ‘দেশ হতে দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানোর আকাঙ্ক্ষা ছোটবেলা থেকেই ছিল। যখনই সুযোগ এসেছে, বেরিয়ে গেছি। আবার সুযোগ তৈরির জন্য চেষ্টা করেছি।’
থামবেন না বাবর
সংবাদ সম্মেলনে বাবরকে তাঁর পেশা সম্পর্কে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকেরা। তিনি বলেন, তিনি পেশায় চিকিৎসক। এ পেশা ঠিকঠাক রেখে তিনি বেরিয়ে পড়বেন। তিনি থামবেন না। হিমালয় অভিযানে খাওয়াদাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করলে বাবর বলেন, বেজক্যাম্পে পর্যন্ত ডাল, ভাত ও নানা ধরনের নেপালি খাবার পাওয়া যায়। এর ওপরে নুডলস খেয়েছেন তিনি। আর তাঁবু টানিয়ে ঘুমাতে হয়েছে।
এভারেস্টের পথে পথে মৃতদেহ পড়ে থাকে, এমন কাউকে দেখেছেন কি না, জানতে চাইলে বাবর বলেন, চূড়ায় ওঠার আগে একটা মরদেহ দেখেছেন তিনি। পোশাক-আশাক দেখে মনে হচ্ছিল মরদেহটি খুব বেশি পুরোনো নয়। এর বাইরে আরও দুটি মরদেহ দেখেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের সভাপতি দেবাশীষ বল, প্রধান উপদেষ্টা শিহাব উদ্দিন, বাবরের অভিযানের প্রধান সমন্বয়ক ফরহান জামান, অভিযানের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ভিজ্যুয়াল নিটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এন ফয়সাল, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের পরিচালক ব্রুনো লাক্রাম্প। আলোচনার শুরুতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ক্লাবের হাতে তুলে দেন বাবর।
এরপর প্রধান অভিযান সমন্বয়ক ফরহান জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবর এভারেস্ট ও লোৎসের চূড়ায় একা ওঠেননি। তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধু, স্বজন—সবাইকে নিয়ে উঠেছেন। সবার দোয়া তাঁর সঙ্গে ছিল। তাঁকে অনেকেই আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ। সবার দোয়ায় বাবর গতকাল মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বাংলাদেশে ফিরে আসেন।’