২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে, বেড়েছে হয়রানিও

সরকারি প্রতিষ্ঠানে ঢুকতে নিষেধাজ্ঞা, ওয়েবসাইট থেকেও গোপন করা হয় তথ্য। রয়েছে মামলা-হামলার খড়্গ।

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস

সংবাদ প্রকাশের জেরে গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হামলা, মামলা বা হয়রানির ঘটনা নতুন নয়। বছর বছর এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। পাশাপাশি সাংবাদিকদের তথ্য পাওয়ার সুযোগও দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রবেশ আটকাতে এবং তথ্য সংগ্রহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে চলছে নানা তৎপরতা। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে অলিখিত নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, তথ্য দেওয়ার চেয়ে তথ্যের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারি কর্মকর্তারা বেশি আগ্রহী। যে কারণে তথ্য অধিকার আইন করেও বেশি লাভ হয়নি। উপরন্তু সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত অনেক তথ্য কোনো কোনো সরকারি দপ্তর ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নিয়েছে।

তথ্য পাওয়া নাগরিক অধিকার। জনগণের কাছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি আছে। এটি নিশ্চিতে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সুযোগ নেই।
অধ্যাপক মো. গোলাম রহমান , সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার

কেবল তা-ই নয়, গত ৫ মার্চ শেরপুরের নকলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) দপ্তরে তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চাইতে গিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক শফিউজ্জামানকে কারাগারে যেতে হয়। তাঁকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি ১২ মার্চ জামিনে মুক্তি পান।

এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে আজ শুক্রবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘ধরিত্রীর জন্য গণমাধ্যম’। প্রতিবছর ৩ মে দিবসটি পালন করা হয়। ১৯৯১ সালে ইউনেসকোর ২৬তম সাধারণ অধিবেশনের সুপারিশ মোতাবেক ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভা তারিখটিকে দিবসের স্বীকৃতি দেয়।

দপ্তরে প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা

সরকারি, আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত দপ্তর এমনকি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানেও পেশাগত কাজে প্রবেশ করতে বা তথ্য সংগ্রহে গিয়ে বহুমুখী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন সাংবাদিকেরা।

এক মাস ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা চলছে। এতে গণমাধ্যমকর্মীরা তথ্য সংগ্রহে আগের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রবেশ করতে পারছেন না। এ নিয়ে সম্পাদক, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদ ও উদ্বেগ জানিয়েছে।

শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। আগে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এ প্রতিষ্ঠানের ৯টি তলার যেকোনোটিতে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে নির্ধারিত খাতায় নাম লিখে পাস নিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু ২০২২ সালের অক্টোবরের শেষ দিক থেকে নিয়ম করা হয়, সাংবাদিকেরা শুধু মুখপাত্রের কাছে যেতে পারবেন। অন্য কোনো তলায় যেতে হলে, যার কাছে যাবেন, তাঁর থেকে পাস নিতে হবে। এ ছাড়া ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়। এর মাধ্যমে কোনো গণমাধ্যমে শেয়ারবাজার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংবাদ ছাপা হলে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক আগের কয়েক দিনে কার কাছে গেছেন, সেটা বের করা যায়। যার কারণে সম্ভাব্য হয়রানি এড়াতে কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলেন বলে এ বিটে কর্মরত একাধিক সংবাদকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

এখন প্রায় একই রকম পরিস্থিতি বেশির ভাগ সরকারি দপ্তরে। ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’র কথা বলেও অতিরিক্ত কড়াকড়ি আরোপ হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানে। এ ছাড়া সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রবেশে সংবাদপত্রগুলোর জন্য যে প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেটার সংখ্যাও গত কয়েক বছরে কমানো হয়েছে।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুলের মতে, প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাংবাদিকদের প্রবেশ একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে কেউ যখন তথ্য চাইবেন, তা পাওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। তবে সাংবাদিকেরা ঢুকতে পারবেন না, এটা হতে পারে না।

এক মাস ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা চলছে। এতে গণমাধ্যমকর্মীরা তথ্য সংগ্রহে আগের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রবেশ করতে পারছেন না। এ নিয়ে সম্পাদক, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদ ও উদ্বেগ জানিয়েছে।

তথ্য থাকে না ওয়েবসাইটে

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের ওয়েবসাইটে নিয়মিত বিভিন্ন সভার কার্যবিবরণী দেওয়া হতো। চলতি বছরের জানুয়ারির পর থেকে ওয়েবসাইটে এই তথ্যগুলো দেওয়া হচ্ছে না। পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়েবসাইট থেকেও সরানো হয়েছে সারা দেশের অপরাধ পরিসংখ্যানের তথ্য। উল্টো গত কয়েক বছরে পুলিশ সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের প্রবেশেও বাড়তি কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।

সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ও আজকের পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক মো. গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তথ্য পাওয়া নাগরিক অধিকার। জনগণের কাছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি আছে। এটি নিশ্চিতে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশের সাংবাদিকতা নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে আছে। একসময় যতটুকু স্বাধীনতা ছিল, সেটা ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে একটা সীমিত জায়গায় এসে ঠেকেছে। তিনি বলেন, এই সরকারের সময় গণমাধ্যমবিষয়ক যতগুলো আইন হয়েছে, তার মধ্যে তথ্যের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার আকাঙ্ক্ষাই বেশি প্রতিফলিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বার্ড কলেজের ভিজিটিং অধ্যাপক ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক ফাহমিদুল হক

মামলা-হামলার খড়্গ

নতুন নতুন আইন করেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অন্যতম। সেন্টার ফর গভর্নমেন্ট স্টাডিজের (সিজিএস) এক গবেষণা তথ্য বলছে, পাঁচ বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় ৪ হাজার ৫২০ জন অভিযুক্ত হন। যাঁদের ২৯ দশমিক ৪০ শতাংশ সাংবাদিক।

ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে নাম পরিবর্তন করে গত বছর সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হয়। সাইবার নিরাপত্তা আইনে এ পর্যন্ত ৯টি মামলার তথ্য পেয়েছে সিজিএস; এসব মামলায় ১৪ জন সাংবাদিক আসামি।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর সংবাদ প্রকাশের জন্য ২৯২ জন সাংবাদিক হামলা, মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। একজন নিহত হয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের বার্ড কলেজের ভিজিটিং অধ্যাপক ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক ফাহমিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের সাংবাদিকতা নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে আছে। একসময় যতটুকু স্বাধীনতা ছিল, সেটা ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে একটা সীমিত জায়গায় এসে ঠেকেছে। তিনি বলেন, এই সরকারের সময় গণমাধ্যমবিষয়ক যতগুলো আইন হয়েছে, তার মধ্যে তথ্যের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার আকাঙ্ক্ষাই বেশি প্রতিফলিত হয়েছে।